এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণেই যা দেখে পীড়িত হই তা হলো, আমাদের জনসংখ্যার চেয়ে অনেক কম জনসংখ্যার দেশের বিমানবন্দরে অসংখ্য উড়োজাহাজের বিপরীতে আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুটি কয়েক উড়োজাহাজ। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ৮০ মিনিটে ৬০টি উড়োজাহাজ উড়ে গেলেও আমাদের সারা দিনের ফ্লাইটের তালিকা এক পর্দাতেই আঁটা। বিদেশি খবরের কাগজ পড়লে মনে হয়—সাংহাই, হংকং, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর ও ব্যাংকক থেকে ক্ষুদ্র নেপাল কিংবা আমাদের এক-দশমাংশ জনসংখ্যার শ্রীলঙ্কার শেয়ারবাজারেও উত্থান-পতন আছে; নেই শুধু বাংলাদেশে। এখানে শেয়ারবাজার কেবলই নিম্নমুখী। আমাদের শিক্ষা, খেলাধুলা, বিনোদনও অন্য কোনো দেশের সংবাদ হতে পারছে না। ভাগ্যিস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। সেই সুবাদে একটু খবর ছাপা হয়েছে মালয়েশিয়ার খবরের কাগজে। তবে আমাদের কোনো নেতিবাচক খবরই বিদেশিদের চোখ ফাঁকি দিতে পারছে না। রাজনৈতিক হানাহানি, ছাত্রদের মারামারি, বন্যা, প্লাবন।
এবার বাংলাদেশের ছাত্ররা দশমবারের মতো আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য পিএইচপি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে অবস্থান করছিল। ছাত্রদের মেধার ওপর ভর করে আমারও সেই সফরে সঙ্গী হওয়া। ৪০ বছর আগে রাশিয়ায় পড়তে গিয়েছিলাম আর এই বছর সেখানে আবার যাওয়া হলো। একই কথা পাশের দেশ থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে, যেখানে আবার ৩০ বছর পর গেলাম। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের মেধাবী ছাত্র, যশস্বী শিক্ষাবিদ এবং অনুকরণীয় মানুষ ড. মঞ্জুর মুর্শেদের সুবাদে ২৬ বছর পর সেখানে আবার পা রাখা। এবার আবার পাঁচ বছর পর একই দেশে তৃতীয় সফর।
বিভিন্ন দেশের অধ্যাপকদের সঙ্গে আলাপ হয় নানা বিষয়ে। আমার নেম ট্যাগে বাংলাদেশ দেখেই সবার আলোচনার বিষয় পাল্টে গেল। আমাদের নানা দুঃখ-দুর্দশায় তাঁদের অযাচিত সহমর্মিতা বর্ষিত হলো। বললাম, দেখো, তোমরা অস্ট্রেলিয়ানরা আমাদের ৮৭ গুণ বেশি জায়গা নিয়ে আমাদের সাত গুণ কম জনসংখ্যার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করছ। সদা ভয়, ইন্দোনেশিয়ার ১০ শতাংশ মানুষ তোমাদের দেশে ঢুকে পড়লে কী বিপদেই না পড়বে! আর আমরা পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূখণ্ডে ২৪ সহস্রাংশ মানুষের দেখভাল করছি। তোমাদের যে ভূমি আর অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার সদ্ব্যবহার এখনো করতে পারছ না তোমরা। অথচ আমার দেশটি দেখো। বন্যা, প্লাবন, সিডর ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর জন্য আমাদের দোষারোপ করার সুযোগ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনগণের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা আমরা করছি। মাত্র ছয়টি দেশ অনেক গুণ বেশি ভূমি ও ততোধিক বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আমাদের থেকে বেশি মানুষের বাঁচার ব্যবস্থা করছে।
পৃথিবীর ২৪৯টি দেশের মধ্যে আয়তন অনুযায়ী আমাদের অবস্থান ৯৪। সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, রাশিয়া ও জাপানের জনঘনত্ব হলো প্রতি বর্গকিলোমিটারে যথাক্রমে ১৪০, ১০০, ৩২, ১২০, ২৩, ২০০, ১১০০, ১৬০, ৮ ও ৩১০। অর্থাৎ জনবহুল দেশগুলোর জনঘনত্ব আমাদের থেকে অনেক কম। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার জনঘনত্ব যথাক্রমে মাত্র ৩ ও ৩ দশমিক ৪।
অর্থাৎ আমরা যে জায়গাটুকুতে এক হাজার ১০০ মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থা করছি, একই জায়গায় অস্ট্রেলিয়া করছে মাত্র তিনজনের আর কানাডা করছে ৩ দশমিক ৪ জনের। শুধু জীবনধারণের ব্যবস্থা নয়, আমাদের রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই গোটা এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ, পৃথিবীর অর্ধেক কণার নাম আমাদের বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের নামে, রেডিওর মতো কালজয়ী আবিষ্কারও করেছে আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, যিনি প্যাটেন্ট করার কথা চিন্তাও করেননি এবং সেই ফাঁকে মার্কনির ভাগ্যের শিকেয় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি সেই দেশটিকে কীভাবে অগ্রাহ্য করা যাবে? যে দেশ সারা পৃথিবীর ২৪ সহস্রাংশ মানুষকে মাত্র এক-সহস্রাংশ ভূখণ্ডে সীমিত সম্পদ ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই দেশটি মোটেই করুণার পাত্র নয়। উন্নত দেশগুলো পৃথিবীর বিশাল এলাকা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা জলবায়ু দূষণ করছে, অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।
আমার এই সফরে সিডনি থেকে পার্থে যেতে পার্থের প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তিন হাজার কিলোমিটারের মধ্যে অবতরণ করার জায়গা না পেয়ে বিমান মেলবোর্নে অবতরণ করতে বাধ্য হলো। অথচ আমাদের অনগ্রসর দেশে বড়জোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যেই আরেকটা বিমানবন্দর মিলে যাবে। প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সাম্প্রতিক একটি বইয়ে জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জন্ম ও মৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমানে জিডিপিসহ অন্যান্য সূচক একটি দেশের সাফল্যকে যথাযথভাবে চিত্রিত করতে পারছে না। নতুন সূচকের প্রয়োজন যেখানে একটি দেশ কতটা দক্ষতার সঙ্গে তার প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে কী পরিমাণ জনগণের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করছে, তা নিরূপিত হবে। বা বলতে পারি, একজন মানুষের জন্য একটি দেশ পৃথিবীর কতটুকু জায়গা এবং কী পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছে সেই অনুযায়ী তাদের সূচক নির্ধারিত হওয়া উচিত। নানা সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও সেই র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ঈর্ষণীয়, সেখানে আমাদের কোনো সহমর্মিতার প্রয়োজন হবে না, বরং এখন যারা সমৃদ্ধিশালী দেশ বলে পরিচিত, আমরা তাদের টুপিখোলা অভিনন্দন আদায় করতে সক্ষম হব।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।