মুক্তিযুদ্ধের স্মারকটি কি রক্ষা পাবে না?

‘অনেক দিন পর বাড়ি মুকু? ভালো আচো তো বু?’

‘আরে আজিবার না? কী অবস্থা?’

‘অবস্তা কিরাসিন। একবার খালি তাকি দ্যাকো।’

সুন্দরবন এক্সপ্রেস ভরদুপুরে নামিয়ে দিয়ে গেল আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে। তাকিয়ে দেখি চারদিক প্রায় ধু ধু। পরবর্তী ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা ১০-১২ জন মানুষ কেউ হাঁটু তুলে বসে উল্টোদিকে অবারিত ধানখেতের দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ মোবাইলে সজোরে আলাপ করছে: ‘ইস্টিশনে আইসি শুনলাম দেড় ঘণ্টা লেট। মাইজি ভাবি রুই মাছের মাথাডা পাতে দিইলু, কুনুমতে নাকেমুকি গুইজি আলাম। থির হইয়ি খাতিও পারলাম না।’ কয়েকজন কিশোর গোল হয়ে স্মার্ট ফোনে কী যেন দেখছে আর অস্ফুট ধ্বনিতে খিকখিক করে হাসছে। বাদামওয়ালা ছেলেটা কংক্রিটের বেঞ্চে পা মেলে দিয়ে নিজের ঝুড়ি থেকে একটা বাদাম তুলে নিয়ে খাবে কি না ভাবছে।

লাল পিরান পরে একমাত্র কুলি আজিবার আমাদের ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে যেন পাতালে নেমে গেল। কোনো ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল না, কেউ সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেনের আগমন বার্তা জানান দিলেন না। আপ-ডাউনের পাখাও ওঠানামা করছে না, কোনো বাতিও জ্বলছে না। এই আমাদের বর্তমান আলমডাঙ্গা স্টেশন। জনবলের অভাবে সারা দেশে শতাধিক রেলওয়ে স্টেশনে এরূপ অচলাবস্থা চলছে।

লোকশ্রুত এবং সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চতম এবং দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনটি ১৮৬২ সালে দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। ইতিহাস বলে এ রেলওয়ে স্টেশনটি একসময় নীলকর ইংরেজদের একটি কুঠি ছিল। ভবনটির ওপরে বসে ইংরেজ সাহেব নীল চাষ সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। নিচতলা ছিল জেলখানা ধরনের আলো–বাতাসহীন গুপ্ত কক্ষ। নীল চাষে অস্বীকৃত চাষিদের আটকে রেখে এখানে নির্যাতন করা হতো। আরও জানা যায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি এবং জগতিতে চিনিকল প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করে। রেলপথটি দর্শনা থেকে আলমডাঙ্গা হয়ে জগতি গিয়ে শেষ হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে স্টেশনটি স্টেশনমাস্টারসহ অন্যান্য জনবলের অভাবে একপ্রকার অচল। শতাধিক বছরের স্থাপনাটির ভগ্নদশা প্রবীণদের শৈশবের স্মৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। অথচ উচ্চশিক্ষা, উচ্চপদ, রাজনীতি, ব্যবসায় ও নারী প্রগতির ভূমিকায় আলমডাঙ্গা উপজেলা অগ্রগণ্য। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ জানুয়ারি রেলওয়ে স্টেশনটির টিকিট মাস্টারের কার্যক্রম বাদে অন্য সব কার্যক্রম বন্ধের চিঠি দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। ট্রেন আসা-যাওয়া তদারকির দায়িত্বে কেউ থাকবে না। যেখানে স্টেশনের লোকবল থাকা অবস্থায়ই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয় না, সেখানে অরক্ষিত স্টেশনে যন্ত্রদানবদের নিয়ন্ত্রণ কে নেবে? এ ছাড়া এই স্টেশনের অনতিদূরেই কুমার নদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ১৯০৯ সালে তৈরি রেলওয়ের বিখ্যাত লাল ব্রিজ। এটার তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণও নেই বললেই চলে। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ও এর লাল ব্রিজটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একাত্তরে আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনটি নজরে রাখার জন্য লাল ব্রিজটির দুই পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্প বসায়। আলমডাঙ্গার অদূরেই মেহেরপুর। মেহেরপুরে কোনো রেলওয়ে স্টেশন নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মেহেরপুরের মুজিবনগরে (তখনকার বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সেখানে শপথ গ্রহণ করেন। চুয়াডাঙ্গা আর আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ব্যবহার করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে এই অকুতোভয় নেতাদের মেহেরপুরে যাতায়াত করতে হয়েছে অনেক সময়। এ অঞ্চলের মুক্তিকামী জনতা, মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা তাঁদের নেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রেখে রেলওয়ে স্টেশন পাহারা দিতেন।

ওদিকে লাল ব্রিজের ক্যাম্প থেকে নৃশংস পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্য সন্দেহে প্রতিদিন উঁচু রেলওয়ের ঢালে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠত। এমনকি সারি দিয়ে গুলি করে হত্যা করার আগে কান্নায় ভেঙে পড়া ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোকে দিয়ে তাঁদের কবর খুঁড়িয়ে নিত। আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ও এর লাল ব্রিজটি শত শত শহীদের রক্তে সিঞ্চিত। এ রেলওয়ে স্টেশনটির গা ঘেঁষেই এখনো গুমরে কাঁদে সেই বধ্যভূমি।

এই বধ্যভূমির সংরক্ষণ যেমন অপরিহার্য, তেমনি অনস্বীকার্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বেদনাবিজড়িত প্রত্নপদবাচ্য এ রেলওয়ে স্টেশনটির সঠিক পরিচর্যা। নান্নু, টগর, আশু, মনোয়ারা, রওশন আরার মতো অগণিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রিয় রেলস্টেশনটি পূর্ণোদ্যমে সচল রাখার প্রত্যাশা কি খুব বেশি চাওয়া এ সরকারের কাছে?

 উম্মে মুসলিমা কবি ও কথাসাহিত্যিক

muslima.umme@gmail,com