অ্যাসাঞ্জের প্রতি ট্রাম্পের ভালোবাসার অবসান?

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কারাজীবন নাটকীয়ভাবে শুরু হলো। লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাস ভবনে ঢুকে পুলিশ তাঁকে আটক করেছে। ব্রিটিশ আদালতের জামিন লঙ্ঘনের জন্য ২০১২ সালে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জেরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে, অ্যাসাঞ্জের একজন আইনজীবী জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণ (একসট্রাডিশন) অনুরোধও তাঁকে গ্রেপ্তার করার একটি কারণ।

বৃহস্পতিবার লন্ডনের মেট্রপলিটন পুলিশ জানিয়েছে যে, রাষ্ট্রদূতের অনুরোধেই পুলিশ তাঁকে দূতাবাস থেকে গ্রেপ্তার করেছে। জামিন নবায়নের জন্য তিনি আদালতে হাজির না হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইকুয়েডর দূতাবাসে এবং সেখানেই কেটেছে তাঁর সাত বছর। কিন্তু, এই সাত বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে অসংখ্য পালাবদল ঘটেছে এবং সেগুলোর মধ্যে দুটি দেশের ক্ষমতার রদবদলের প্রত্যক্ষ প্রভাব তাঁর ওপরে পড়েছে।

এই দুটি পরিবর্তনের একটি হচ্ছে ইকুয়েডরের নির্বাচনে তাঁর আশ্রয়দাতা প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়ার বিদায়। তাঁর উত্তরসূরি লেনিন মরিনো আর অ্যাসাঞ্জের দায়ভার বহন করতে রাজি ছিলেন না। তারই পরিণতি এই রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিলের সিদ্ধান্ত। বলা চলে, ফেরারি অ্যাসাঞ্জকে তিনিই এখন ব্রিটিশ পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছেন। রাফায়েল কোরেয়া তাঁর উত্তরসূরির সিদ্ধান্তের নিন্দাও করেছেন।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করেছে লন্ডনের পুলিশ। ১১ এপ্রিল, যুক্তরাজ্য। ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় যে পালাবদলের ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টতই অ্যাসাঞ্জের হ্যাকিংয়ে লাভবান হয়েছেন—তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল ফাঁস করার ঘটনা ছিল ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিকবার নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রশংসা করেছেন। অথচ, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁসের অভিযোগে অ্যাসাঞ্জ ছিলেন অভিযুক্ত আসামি। এবং, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিচারের জন্য তাঁকে যাতে তুলে দেওয়া না হয় সে জন্যেই তিনি ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি এখন আর বলবেন ‘আই লাভ অ্যাসাঞ্জ’ (অ্যাসাঞ্জকে আমি পছন্দ করি/ভালোবাসি)?

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে প্রথম যে মামলায় গ্রেপ্তার, জামিন এবং তা লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটেছে সেই মামলাটি ছিল সুইডেনে একজন নারীকে ধর্ষণের মামলা। সেই মামলায় সুইডেন তাঁকে তাদের আদালতে বিচার করতে চেয়েছিল এবং অভিযুক্তকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু, সেই অভিযোগ পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু, ইত্যবসরে যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে রাশিয়ার ভূমিকার বিষয়ে মুলারের তদন্তসূত্রে এই মামলার কথা ফাঁস হয়ে গেছে। সুতরাং, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের সম্ভাবনা এখন প্রবল। আগেও তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে সুইডেন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বললেও তাঁরা আসলে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তুলে দেবেন।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার যেসব প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে: একটি দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পর তা কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া বাতিল করতে পারে কি? আশ্রয় যদি শর্তসাপেক্ষ হয়ে থাকে, তাহলে শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তা বাতিল করা আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে কি?জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষজ্ঞরা গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় ইকুয়েডর দূতাবাসে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে সমর্থনযোগ্য নয় বলে এর আগে একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছেন। সংস্থার ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন গত ডিসেম্বরের ২১ তারিখেও একটি বিবৃতিতে তাঁকে অবাধে দূতাবাস থেকে বেরিয়ে মুক্তভাবে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবী ব্যারিস্টার জিওফ্রে রবার্টসন অ্যাসাঞ্জের আশ্রয় বাতিলের জন্য ইকুয়েডরের সমালোচনা করে বলেছেন যে দেশটি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কাজ করেছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বিভিন্ন গোষ্ঠীও এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে। রুশ সরকারের মুখপাত্র গ্রেপ্তারের নিন্দা করে অ্যাসাঞ্জের মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেই আহ্বান জানিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প



সন্দেহ নেই, অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকসের কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের অনেক দেশের ক্ষতির কারণ হয়েছে। বিশেষ করে তা ওইসব দেশের অনুসৃত বিভিন্ন নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের বিব্রত করেছে। আন্তর্জাতিক জনমত ও আইন উপেক্ষা করে পরিচালিত ইরাক যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে অ্যাসাঞ্জ বিপুল জনসমর্থন পেয়েছেন। বলা চলে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে তিনি অভূতর্পূব সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু, ২০১৬ তে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময়ে তাঁর কার্যক্রম স্পষ্টতই বহুল বিতর্কিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচন জিততে সহায়তা করেছে। এই পক্ষপাত অ্যাসাঞ্জকেও যে বিতর্কিত করেছে, সন্দেহ নেই। প্রশ্ন উঠছে মি. অ্যাসাঞ্জ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করলে তিনি রাশিয়ার বিভ্ন্নি বিতর্কিত বিষয়গুলোতে এত বছরেও কিছুই প্রকাশ করলেন না কেন?

অনেক যৌক্তিক প্রশ্নেরই উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু, এটুকু স্পষ্ট যে অ্যাসাঞ্জকে সত্যপ্রকাশের জন্য যদি বিচারের মুখোমুখি করা হয় তাহলে তা সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকি তৈরি করবে। তাঁর আইনজীবীদের মতো আমরাও আশাবাদী হতে চাই যে ব্রিটেনের আদালত সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে ভিন্ন আরেকটি দেশের হাতে তুলে দেবে না। জামিন খেলাপের জন্য অপরাধী হলেও সাংবাদিকতার জন্য তিনি অপরাধী হবেন না এটাই প্রত্যাশা। ব্রিটেনের আইনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রত্যর্পণের যৌক্তিকতার বিষয়ে আদালতে শুনানি এবং আপিলের যে সুযোগ রয়েছে তা বেশ দীর্ঘ বলে হয়তো আমাদের অপেক্ষাও হয়তো আরেকটু দীর্ঘায়িত হবে।

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক