প্রকৌশলীদের মারধরের হিড়িক ও রাজনৈতিক 'ঔষধ'

আ জ ম নাছির উদ্দীন। ফাইল ছবি
আ জ ম নাছির উদ্দীন। ফাইল ছবি

সম্প্রতি দেশের এক নগরপালের হাতে নগরে কর্মরত একজন প্রকৌশলীর শারীরিক লাঞ্ছনার খবর নিয়ে সেই নগরের সঙ্গে সঙ্গে দেশও বেশ সরগরম। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য–বিবৃতি চলছে। উভয় পক্ষই যথেষ্ট সংঘবদ্ধ। তার মধ্যে যোগ হয়েছে জেলার চর্চা।‘অমুক জেলায় আমার বাড়ি বলার পরেও আমাকে ছাড়েনি’ টাইপের কথাবার্তা প্রকাশিত হয়েছে নানা প্রচারমাধ্যমে। তবে কি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিটির দুঃখ চড়–থাপ্পড়ে নয়, তাঁর দুঃখ তাঁর জেলাকে সমীহ না করা? কিংবা তিনি জেলার কথা তুলে নগরপালেরব ঔদ্ধত্যকে অন্য মাত্রা দিতে চাচ্ছেন, ‘রাজনীতি’ করছেন। দলীয় রাজনীতির চশমা দিয়ে সব কিছুর বিচারের রেওয়াজ আমাদের কোন কানা গলিতে নিয়ে যাবে কে জানে?

ইদানীং কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে অমুক নেতা তমুক আমলাকে পিটিয়েছে, তমুক আমলা তাঁর অধস্তনকে গালি দিয়েছে কিংবা জনপ্রতিনিধিরা পেটাচ্ছেন যাকে খুশি তাকে বা উত্তমমধ্যম দেওয়ার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন খোলা মাঠে মাইকের সামনে। বেশির ভাগ প্রকাশিত সংবাদে প্রকৌশলীদের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা লক্ষণীয়। নিশ্চয় এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।

যখন তখন যেখানে–সেখানে গায়ে হাত তোলা লাঞ্ছিত করা অপদস্থ করা কি আমাদের খাসলতের একটা অনিবার্য অংশ হয়ে যাচ্ছে? নইলে শৈশবে শোনানো প্রথম ছড়াগুলোর মধ্যে কেন মারা–বকা–গালির কথা থাকবে? সেই ছেলেবেলা থেকেই মারা–বকা–গালি কি হয়ে ওঠে আমাদের নিত্য সহচর? তারপর হাতে–পায়ে বড় হলে আমাদের আর বলতে হয় না মারপিট, বকাঝকা আর গালাগালের স্থান কাল পাত্রের ঠিকানা সময় আর তরিকা। মারপিট লাঞ্ছনা শুরু করে দিই যে যার মর্জিমাফিক। যে দুর্বল যার প্রতিবাদের ক্ষমতা কম বা শূন্য কিংবা তা শোনার কেউ নেই তাকেই আমরা করি পয়লা টার্গেট। পাড়ার খেলার মাঠ, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত কর্মস্থলে চলতে থাকে হাত তোলাতুলির বাহাদুরি। শ্মশান–গোরস্তান বাদ যাচ্ছে কি? সেদিন এক হোমরাচোমরার দাফনে গিয়ে কবরের সাইজ নিয়ে দুই দলের আস্তিন গোটাতে দেখে কেউ অবাক হলো না!


দক্ষিণের নগরপালের বিতর্কিত আচরণের মাস পনেরো আগে (ডিসেম্বর ২০১৭) উত্তর–পূর্বের অন্য এক নগরের নারী কাউন্সিলরের (ক্ষমতাসীন দলের সদস্য) হাতে লাঞ্ছিত হন নগরের প্রধান প্রকৌশলী। ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭ মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে ওই কাউন্সিলর নগর ভবনে প্রধান প্রকৌশলীর কক্ষে গিয়ে তাঁর ওয়ার্ডের একটি উন্নয়নকাজ করে দিতে বলেন। প্রস্তাবিত কাজটি প্রকৌশলীর এখতিয়ার–বহির্ভূত হওয়ায় তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে দুজনের মধ্যে কথা–কাটাকাটি শুরু হয়। একপর্যায়ে প্রধান প্রকৌশলীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন কাউন্সিলর। এ খবর নগর ভবনে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভের একপর্যায়ে নগর ভবনের ৩০৪ নম্বর কক্ষে নারী কাউন্সিলরকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। শেষ পর্যন্ত নগরপালের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি তখনকার মতো শান্ত হলেও এর রেশ চলে অনেক দিন। ঘটনার পাঁচ–ছয় দিন পর সচেতন নাগরিক সমাজের আড়ালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্যরা এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নারী কাউন্সিলরের ওপর হামলা, মারধর, গাড়ি ভাঙচুর ও যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে তাঁকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

উত্তর জনপদের অন্যতম নগর ভবনের মধ্যেই ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর লাঞ্ছিত করেন বস্তি উন্নয়ন শাখার প্রজেক্ট কর্মকর্তাকে। গত ডিসেম্বরের এই ঘটনার প্রতিবাদে নগর ভবনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করেন। বস্তি উন্নয়ন শাখায় কমিউনিটি অর্গানাইজার পদে জনবল নিয়োগে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী প্রজেক্ট অফিসার নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাঁর গায়ে হাত তোলেন জনপ্রতিনিধি ওয়ার্ড কমিশনার।

গত ২৪ মার্চ ২০১৯ তারিখে দক্ষিণের জেলা শহর বাগেরহাটের সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে রাজনৈতিক যোগাযোগের বলে বলীয়ান ঠিকাদার লোহার রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী কাজের ‘সাইট’ হঠাৎ পরিদর্শনে গিয়ে কাজের মান নিয়ে আপত্তি তুললে মারধরের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। হত্যার হুমকিসহ লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ঠিকাদার ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

একই কিছিমের ঘটনার খবর চাউর হয় বরিশালের বানারীপাড়া, কুমিল্লার আখাউড়া, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, নরসিংদীর মাধবদীসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে। তদন্ত কমিটি কোর্টকাছারি মামলা–মোকদ্দমা চলে, কূলকিনারা হয় না। মারামারি, বকাঝকা, গালাগাল আমাদের প্রশাসনের অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। শুদ্ধাচার অনুশীলনের অঙ্গীকার দিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিশ্চয় সেটা পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়নি। মারধরের কালচার জারি রেখে সেটা কি অর্জন করা সম্ভব? কথায় বলে ‘মারের ওপর ঔষধ নাই’। যে দেশে এ রকম প্রবাদ প্রচলিত এবং তাতে আস্থা রাখেন রাজনৈতিক লোকজন, সে দেশে শান্তি আসবে কীভাবে?

চাপে হোক খুশিতে হোক ঠ্যালায় কিংবা বেড়াতে গিয়ে হোক, মার খাওয়ার পর মান–অভিমান–মামলা ঝামেলাকে এক পাশে সরিয়ে অনেকেই নব্বই ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ান। বলেন স্রেফ ভুল–বোঝাবুঝি, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি, এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগও নেই। বড় ভাই হিসেবে শাসন করতেই পারেন তবে তিনি আদরও করবেন। এই তো তিনি যাওয়ার আগে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাদের আদর করেছেন। মামলা ডিসমিস। আসলে কি ডিসমিস হয়? স্বার্থ বারবার এসে সবকিছুতে জট পাকায়।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]