খয়রাতি জীবনে বৈশাখী উল্লাস!

নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সামনে নারী সংহতির কর্মীদের মানববন্ধন। ওই কর্মসূচিতে নুসরাতের ছবি হাতে একজন। শাহবাগ, ঢাকা, ১২ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সামনে নারী সংহতির কর্মীদের মানববন্ধন। ওই কর্মসূচিতে নুসরাতের ছবি হাতে একজন। শাহবাগ, ঢাকা, ১২ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

‘খয়রাতি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘দানরূপে প্রাপ্ত’। অর্থাৎ কারও দানে বা দয়ায় যা পাওয়া যায়, তা-ই খয়রাতি। এ দেশে আমাদের জীবনও এখন খয়রাতি হয়ে গেছে। আর সেই জীবন কার দয়ায় পাওয়া যাচ্ছে? অপরাধীদের, নিপীড়কদের!

অপরাধী বা নিপীড়কদের হাত থেকে আমরা বেঁচে আছি কীভাবে? কারণ তারা দয়া করে আমাদের রেহাই দিচ্ছে। অফিসে যাওয়ার সময় কোনো গাড়ি আপনার ওপর উঠে না যাওয়ার অর্থ হলো—সঠিক প্রশিক্ষণ না পাওয়া কোনো গাড়ির চালক আপনাকে রেহাই দিয়েছে। আপনার স্ত্রী বা বোন রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় উত্ত্যক্তের শিকার হয়নি—এর অর্থ কিছু বিকৃত মনোভাবের পুরুষ তাঁদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে অপমান করেনি। রাতে বাড়ি ফেরার পথে আপনার বাবা বা ভাইকে কেউ বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি বা পেটে ছুরি মেরে টাকা ছিনিয়ে নেয়নি—এর অর্থ হলো চালকের সহকারী বা কোনো মাদকাসক্ত সন্ত্রাসী তাঁদের দয়া করে ছেড়ে দিয়েছে।

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

এমন অসংখ্য অপরাধী ও নিপীড়কের দয়ায় এখন আমরা বেঁচে আছি, নিজেদের ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছি। খয়রাতি এই জীবন নিয়েই আমরা ফেসবুকে তোলপাড় করছি। ভার্চ্যুয়াল জগৎ ছেড়ে সত্যিকারের পৃথিবীতে আমরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ছি না। কারণ আমরা ভাবছি, আমার ওপর তো আর নির্যাতন হয়নি! সুতরাং প্রতিবাদের নামে সময় নষ্ট (!) করার কোনো অর্থ নেই। এর চেয়ে বরং ভাতঘুম দেওয়া শ্রেয়। তাই আমরা ঘুমিয়ে পড়ছি। ঘুম ভাঙার পরও তার রেশ আর কাটছে না। কারণ আমরা বুঝতে শিখেছি, ঘুম ঘুম চোখেই নির্বিবাদে দিন কাটানো যায়। ঢুলু ঢুলু নয়নে অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করা যায়। যত কম দেখবেন, তত কম জানবেন। আর যত কম জানবেন, ততই শান্তি।

এ দেশে শিকারি কম, শিকার অনেক। সময়ে কুলাচ্ছে না বলে কাউকে কাউকে তাই ছেড়েই দিচ্ছে শিকারি তথা অপরাধীরা। নিজের পালা আসছে না বলে আমরাও খুশি থাকি। এভাবেই চলছে সব। এই খয়রাতি জীবনে আনন্দ-উল্লাসও আসে, উৎসব আসে। আজ বাদে কাল পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আমাদেরও উল্লাসে মেতে ওঠার কথা। কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় জানি খচখচ করছে। ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের মৃত্যু সেই খচখচানি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

অথচ আগে এমন নৃশংস ঘটনা খুব কমই নজরে আসত। শৈশবে আমাদের অভিভাবকেরা গম্ভীর মুখে ইয়াসমিনের প্রসঙ্গ টানতেন। বাচ্চাদের পাশ কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন তাঁরা। তখন অবশ্য আমরা ‘ধর্ষণ’ শব্দটার অর্থ জানতাম না। জ্ঞানগম্যি হওয়ার পর যখন জানাবোঝা হলো, তখনো এই সমাজের নৃশংসতার উদাহরণ টানতে কিশোরী ইয়াসমিনকে মনে করতে হতো। দিনাজপুরে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী ইয়াসমিনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পিকআপ ভ্যানে তুলে ধর্ষণ করেছিলেন পুলিশের কিছু সদস্য। পরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ দিনাজপুর দশমাইল মহাসড়কের পাশে ফেলে দেওয়া হয়। ওই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে দিনাজপুরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। সেই অপরাধের বিচার হয়েছিল। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এরপর অনেক দিন ধরে এই জনপদে নৃশংসতা ও নিপীড়নের উদাহরণ ছিল ইয়াসমিন। আর এখন নামের অভাব নেই। তনু আছে, রুপা আছে। এখন আছে নুসরাত। সড়কে ঝরে যাওয়া প্রাণের মধ্যে আছে আবদুল করিম, দিয়া খানম, আছে আবরার। চাইলে আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। তফাত হচ্ছে, আগে অন্যায়ের প্রতিবাদ হতো। আর এখন গলা ফাটায় নিপীড়ক ও তাঁর সহযোগীরা।

যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ, ঢাকা, ১২ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ, ঢাকা, ১২ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

নুসরাত যখন মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন, ঠিক ওই সময়ই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিওচিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাতে দেখা গেছে, নুসরাতের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার মুক্তি চেয়ে মিছিল-সমাবেশ করছেন অনেকে। অর্থাৎ, নিপীড়কের সহকারীরা সরব থাকলেও নীরব প্রতিবাদকারীরা। এখন অবশ্য কিছু প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে, তবে মেয়েটি চিরতরে চোখ বুজে ফেলার পর। তিনি লড়াই করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে লড়াই করার রসদটুকু জুটিয়ে দিতেও আমাদের অনীহা!

এত সব ঘটনার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি। কাল পয়লা বৈশাখ। এবারও ঢাকার চারুকলা অনুষদ থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই বছরের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য হলো কবিগুরুর লেখা লাইন, ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। আমরাও তা-ই চাই। স্বাধীন দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রাখতে চাই। কোনো অপরাধীর দয়ায় পাওয়া খয়রাতি জীবন আমরা কাটাতে চাই না।

নববর্ষ নতুন জীবনের প্রতীক। অতীতের ভুল ও ব্যর্থতাকে ধুয়ে-মুছে নতুন যাত্রার শুভারম্ভ হবে এদিন। আচ্ছা, নতুন বছরে আমাদের জীবনের ‘স্টিয়ারিং’ আমাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না?

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]