নুসরাতের জন্য কান্না

ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানের মৃত্যু শুধু তাঁর স্বজন ও সহপাঠীদের কাঁদায়নি; কাঁদিয়েছে গোটা বাংলাদেশকে। অগ্নিদগ্ধ নুসরাত হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কয়েক দিন দুঃসহ যন্ত্রণাভোগের পর গত বুধবার রাতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা যেসব বিবরণ দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে ছিলেন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। নারী নির্যাতন মামলায় কারাগারে থেকেও তিনি তাঁর সহযোগী কতিপয় দুর্বৃত্তকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁরা প্রথমে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা নুসরাত মামলা তুলে নিতে রাজি না হলে দুর্বৃত্তরা তাঁকে বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যান।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষের চেয়ারে আসীন সিরাজ উদদৌলা এর আগে দীর্ঘদিন ধরে নুসরাতকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তিনি তাঁর শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা করেন। নুসরাত অধ্যক্ষের অপকর্ম সইতে না পেরে মা-বাবাকে জানালে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ফলে অধ্যক্ষকে কারাগারে যেতে হয়। কিন্তু কারাগারে গিয়েও এই ব্যক্তি নুসরাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভাড়াটে লোক নিয়োগ করেন। নুসরাত মৃত্যুর আগে বান্ধবীদের কাছে যেসব চিরকুট লিখেছেন, তাতে স্পষ্ট যে নিগ্রহের শিকার নুসরাত একবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অন্যায়ের কাছে কখনোই হার মানবেন না। তিনি হার মানেননি, মৃত্যুর আগেও বলে গেছেন তাঁর নিগ্রহের কথা। দুঃখের বিষয়, রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার পর থানার পুলিশ জবানবন্দি নেওয়ার নামে যে জঘন্য কাজ করেছে, যা ভিডিওর কল্যাণে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের অপরাধ দমনে রাষ্ট্র নিয়োজিত কর্মকর্তার বদলে অপরাধের সহযোগী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ঘটনার পর ফুলগাজী থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। ওই ওসি ও তাঁর সহযোগীদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা অতীতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তুলেছিলেন এবং ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপকর্ম চালাচ্ছিলেন। তাঁর অন্যতম সহযোগী নুর উদ্দিনকে পুলিশ ভালুকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। অপর সহযোগী শাহাদত হোসেনকে গ্রেপ্তার করলে রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিরাজ উদদৌলার এই দুই সহযোগীই তাঁর মুক্তির দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন। এই দুর্বৃত্তরাই দিনদুপুরে নুসরাতের শরীরে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অতএব, তাঁদের বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।

নুসরাতের হত্যাকারীদের ধরতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আইন নিজস্ব গতিতে চললে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। নিকট অতীতে তনু, রাফিয়া, মিতু, সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলেও একটিরও বিচার হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্তে অপরাধী চিহ্নিত না হওয়ার অজুহাত তোলা হয়েছে। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে নুসরাত জীবন দিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে সেই অজুহাত তোলার সুযোগ নেই। কেননা, এখানে এই অপরাধের মূল হোতা সিরাজ উদদৌলা ধরা পড়েছেন।

আমাদের কোনো কান্না বা প্রতিবাদই নুসরাতকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু তাঁর হত্যার বিচার হলে নুসরাতের স্বজনেরা অন্তত এই সান্ত্বনাটুকু পাবেন যে অপরাধীরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সেই সঙ্গে দুর্বৃত্তদের কাছে এই বার্তাও যাবে যে অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এভাবে বিচারহীনতার অবসান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।