কেন তারা অপরাধের পক্ষে দাঁড়ায়, মিছিল করে?

ছবি  সংগৃহীত
ছবি সংগৃহীত

‘চুরি করে হলেও দুই ফোঁটা পানি দাও বাবা।’ বাবার কাছে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের তৃষ্ণার্ত আকুতি। শেষ পর্যন্ত পারেননি নুসরাত। হার মানলেন অমোঘ নিয়তির কাছে। শেষনিশ্বাস পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইটা জারি রাখলেন। জীবন দিয়ে উদাহরণ হয়ে থাকলেন নুসরাত। এভাবেই সাহস করে প্রতিবাদ করতে হয়। কিন্তু জীবন শুরুর আগেই যে নুসরাতের চলে যাওয়া অসম্ভব কষ্টের।

সোনাগাজীর এই নৃশংস ঘটনাসহ সাম্প্রতিক কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সমাজে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইশারা দেয়। কিছুদিন ধরে দেশে ধর্ষণের মহামারি শুরু হয়েছে যেন। পাঁচ বছরের শিশু থেকে বয়স্ক নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। কথা–কাটাকাটির জেরে রিকশাচালককে পিষে মারছেন বাসচালক। সহনশীলতা সমাজ থেকে একেবারেই উধাও। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, এসব অপরাধের পক্ষেই সমাজের কোনো কোনো অংশ কথা বলছে। সোনাগাজীর যৌন নিপীড়ক মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই মিছিলের ছবি ঘুরে বেরিয়েছে। প্রায় দুই দশক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্ষকের পক্ষে মিছিল হয়েছিল। তখন করেছিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা। এবার করলেন ধর্মীয় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দাপুটে ছাত্রনেত্রীকে শাস্তির বদলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। অপরাধীর পক্ষে প্রকাশ্যে মিছিল খুব খারাপ আলামত।

দেখতে দেখতেই একটি নৃশংস সমাজের সদস্যে পরিণত হচ্ছি আমরা। একদিকে অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে জনসাধারণই হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। চুরির অভিযোগে কিশোর পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা উপনীত হয়েছি, যেখানে কেউ আইনকে ভয় পায় না। আইনের প্রতি কারও আস্থাও নেই। অপরাধীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয়ের লেশ নেই। বরং ভয়ে থাকে নির্যাতিত, আক্রান্তের পরিজন। নির্যাতিত হওয়ার পরও হুমকি–ধমকি অব্যাহত থাকে। নির্যাতিতের সঙ্গে ক্ষমতার মালিকেরা থাকে না। তারা থাকে অপরাধীদের সঙ্গে। চরম এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চারদিকে।

বলা যেতে পারে, সব অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু আছে। কলুষিত রাজনীতির ফলাফল হচ্ছে আজকের এই অপরাধপ্রবণ সমাজ। অপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। অপরাধ তত্ত্বের অনেক চিন্তার প্রথম দিকের একটি হচ্ছে শিকাগো স্কুল অব থট। শিকাগো স্কুল অব থটের মূল বিষয় হচ্ছে, সামাজিক বিশৃঙ্খলাই অপরাধের মূল কারণ। মার্ক্সবাদী অপরাধবিষয়ক তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা আবার শ্রেণিসংঘাতের কারণে তৈরি হয়। সমাজে বৈষম্যের কারণে ক্ষমতার বিতরণ হয় শ্রেণিগত অবস্থান অনুযায়ী। ক্ষমতাশালীরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকেন। সমাজে আইন ভাঙার প্রবণতা বেড়ে যায়। এটা সমাজের শীর্ষ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। কোনো সমাজে যখন এই অবস্থা বিরাজ করে, তখনই অপরাধপ্রবণতা ও অপরাধীর প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। প্রথমত, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে সুবিধাভোগীরা সমর্থন জানায়। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাশালীদের চাপে ও ভয়ে সাধারণ মানুষ সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। কার্ল মার্ক্স, এমলি ডুরখাইমদের মতে, পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশ ও নগরায়ণের কারণে সামাজিক পরিবর্তন সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধী তৈরি করে এবং সমাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সন্ত্রাসী আর রাজনৈতিক গুন্ডাদের হাতে। পরিস্থিতি এমন হয় যে জনপ্রতিনিধিদের দেখলেই অনেকেরই অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।

সোনাগাজীর ঘটনার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এই ঘটনায় যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যৌন হয়রানির অভিযোগ করা হয়েছে জামায়াতের সাবেক রোকন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, শুক্রবার রাতে মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শিক্ষার্থীর ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দেন। এ ছাড়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বিভিন্ন মাধ্যমে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেন। এখানে একক কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা মুশকিল। দেখা যাচ্ছে, অপরাধীদের মধ্যে রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলেও বিভিন্ন কারণে কার্যত এঁরা সবাই একই পক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী।

এই ক্ষমতার কারণেই নির্যাতিত, আক্রান্তের বিপক্ষে একটি অংশ দাঁড়িয়ে যায়। আশঙ্কাজনক হলো, নিকট অতীতে এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। অপরাধীর পক্ষে যারা গলা চড়ায় বা মাঠে নেমে পড়ে, কার্যত অপরাধের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লেষই নেই। সোনাগাজীতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার পক্ষেও একদল শিক্ষার্থীর মানববন্ধনই প্রথম না, অপরাধীর পক্ষে এর আগেও মানববন্ধন হয়েছে। সিলেটের ছাত্রলীগের নেতা বদরুলের পক্ষে মিছিল হয়েছে। ফেনীতেই এক উপজেলা চেয়ারম্যানকে পুড়িয়ে মারার সন্দেহভাজন আসামির পক্ষেও মানববন্ধন হয়েছিল। কিন্তু হওয়ার কথা বিপরীত। আক্রান্তের পক্ষে সবার মাঠে নামার কথা। মাঠ দখলে থাকার কথা প্রতিবাদী জনতার। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অপরাধীরাই বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপরাধীর পক্ষের লোকজনই বরং মাঠ দখল করে আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই সব মানববন্ধন করছে, এরা কারা? আমাদের সমাজেরই অংশ। কিন্তু এরা অপরাধীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছে কেন? কোন যুক্তিতে, কোন ধারণা থেকে তারা অপরাধীর পক্ষে দাঁড়ায়? অপরাধকে এভাবে গণসমর্থন কেন দিচ্ছে? কোন পথে যাচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ? নাগরিকের অন্যায়ের প্রতিবাদের সাহসটুকু হারিয়ে যাচ্ছে।

অপরাধীর যুক্তি কী? এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করছেন। তাঁদের একজন ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী জোসেফ হর্সফিল্ড। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক অপরাধীই অপরাধ সংঘটনের পেছনে যুক্তি দাঁড় করিয়ে থাকে। অপরাধীর মানসিক গঠনই হয়তো ওই সময় বদলে যায়। অপরাধের পক্ষে তাই অপরাধীর ‘যৌক্তিক বাছাই’ বা দোহাই থাকে। কিন্তু অপরাধীর সমর্থকদের ‘যৌক্তিক বাছাই’ কী? যৌন নির্যাতক, খুনি, ধর্ষকের পক্ষে লোকজন মাঠে নেমে কী করে? এসবের উত্তর হচ্ছে, অপরাধী ও এর আশপাশের সবাই কমবেশি এক কলুষিত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতার সুবিধা ভোগের জন্য অপরাধীর পক্ষে কথা বলে—অথবা চাপে পড়ে।

রাজনীতি–অর্থনীতি, প্রেম–ভালোবাসা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের আড়ালে আমাদের সমাজে ভয়াবহ এক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ইদানীং মিথ্যা বলা ও লোক ঠকানোকে আর বাজে বিষয় হিসেবে দেখা হয় না। বরং সমাজে যে যত বেশি লোক ঠকাতে পারে, মিথ্যা বলে পার পেতে পারে, তাকেই বুদ্ধিমান ও চালাক হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়। এতে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য এক অমানবিক সমাজের বিকাশ ঘটছে। প্রতিবাদের কোনো ছিটাফোঁটাও নেই আমাদের আচরণে। নিজেকে নিয়ে আমরা এতই ব্যস্ত যে আশপাশে তাকানোর সময় নেই বা তাকালে সমস্যা হতে পারে; তাই কেউই চারদিকে তাকাচ্ছে না। তাই রাতভর ডাকাতি হলেও সকালে উঠে আমাদের মনোভাব অনেকটা এ রকম যে আমার তো কিছু হচ্ছে না। সমাজের এই ধরনের নির্লিপ্ততার সুযোগে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

সমাজে দ্বন্দ্ব–সংঘাত থাকেই। তাই বলে একটি সুস্থ–স্বাভাবিক সমাজে মানুষ কীভাবে খুনি, ধর্ষকের পক্ষে কথা বলে? বলছি না আপনাকে মাঠে নামতে হবে। মিছিলে যেতে হবে। আপনার প্রতিবাদের আগুনে সব অপরাধী পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে, তা–ও চাই না। তবে বলছি, আর কিছু না করতে পারুন, অন্তত অপরাধ, অপরাধীর বিপক্ষে কথা বলুন। কণ্ঠ ছেড়ে কথা বলুন। নিজের ঘর থেকেই নীতিনৈতিকতার শিক্ষাবিস্তার শুরু করুন। আইনের প্রয়োগ অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে। কিন্তু এর সঙ্গে সামাজিক আন্দোলনও দরকার। ব্যক্তি পর্যায় থেকেই আন্দোলন শুরু করা দরকার। ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে এই আচরণ ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হবে। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব না। নতুবা ইয়াসমিন, ত্বকী, তনু, নুসরাতদের মিছিল দিন দিন লম্বা হতেই থাকবে।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন