সরব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ

ছায়ানটের বর্ষবরণ। ছবি: প্রথম আলো
ছায়ানটের বর্ষবরণ। ছবি: প্রথম আলো

প্রথা অনুযায়ী ছায়ানট আয়োজিত রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান শেষ হয় সংগঠনের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এবারেও শিল্পীদের গান ও আবৃত্তি শেষে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন। 

কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ঘোষণা না দিয়ে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বললেন, ‘আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করব, আমাদের ক্ষোভ জানাব, প্রতিবাদ জানাব অনাচারের বিরুদ্ধে।...নুসরাত জাহান, তনু, সাগর-রুনি, মিতু…যেসমস্ত বিষয়ে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো খবর পেলাম না বিচারের, সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বিগত প্রাণগুলোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকব।’


নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঘাতকদের, অপরাধীদের বিরুদ্ধে মনের ক্ষোভ প্রকাশ, ঘৃণা প্রকাশ করা। অপরাধের বিচার দাবি করা।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। ছবি: প্রথম আলো
মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। ছবি: প্রথম আলো

সন্‌জীদা খাতুন যাঁদের নাম বলেছেন, তাঁরা সবাই নির্মমতা ও নৃশংসতার শিকার। কেউ দুবছর আগে, কেউ পাঁচ বছর আগে কিংবা আরও বেশি। কিন্তু কোনা হত্যারই বিচার হয়নি। এ কারণে সন্‌জীদা খাতুনের কণ্ঠে ক্ষোভ ছিল। বেদনা ছিল। মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ ১৪২৬ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ। বছর পেরিয়ে আমরা আবার নতুন দিনের মুখোমুখি। কেমন সময় পেরিয়ে এলাম?’


এই প্রশ্ন কেবল একা সন্‌জীদা খাতুনের নয়; এই প্রশ্ন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। মানুষ নিহত হলে কেন তার বিচার হবে না? এর আগে প্রথম আলোর কাছে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় সন্‌জীদা খাতুন বলেছিলেন, ‘আমাদের এবারের থিম সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুদ্ধির সাধনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুদ্ধির সাধনাই কাম্য সবার।’


গেল শতকের ষাটের দশক থেকে ছায়ানট গানের মাধ্যমে, আবৃত্তির মাধ্যমে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শুভবোধ ও শুভচিন্তা জাগিয়ে তোলার পক্ষে কাজ করে আসছে। ১৯৬৭ সালে যে বছর পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী সরকারি বেতারে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিলেন, সে বছরই ছায়ানট রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ পালন করে। প্রথমে আয়োজন ছিল ছোট। এখন সেটি অনেক বড়। আগুনের পরশমণির মতো সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে।


এবারে নববর্ষের আগে যে ঘটনাটি দেশবাসীকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে, তা হলো ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা। মানুষ কতটা পাষণ্ড হলে একজন ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে পারে! আর সেই কাজ করেছেন স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। মাদ্রাসায় বসেই তিনি অধর্মের কাজ করে গেছেন। সিরাজ উদদৌলা আগে জামায়াতে ইসলামী করতেন। অভিযোগ আছে, এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গেছেন। এটাই নাকি তাঁর রক্ষাকবচ। এর আগে নুসরাতের মা তাঁর মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। কিন্তু জেলখানায় বসে তিনি নুসরাতকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করেন।

বর্ষবরণের আয়োজনে নানা শ্রেণির মানুষ। ছবি: প্রথম আলো
বর্ষবরণের আয়োজনে নানা শ্রেণির মানুষ। ছবি: প্রথম আলো

সন্‌জীদা খাতুন যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তনু, মিতু, সাগর, রুনি হত্যার বিচার হবে না? কেন অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে? বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আজ সমাজকে কলুষিত করে চলেছে। খুনি-অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।


নুসরাত হত্যাসহ বেশ কিছু অঘটন জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছিল যে এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সারা দেশে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হবে কি না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আয়োজনের ওপর নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিসরও সংক্ষিপ্ত করার তাগিদ দেয়।
যে নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব, সেটি পালন করতে এত বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে উৎসবে আনন্দই থাকে না। তারপরও মানুষ নিরাপত্তার কথা ভেবে এসব মেনে নিয়েছে। রোববার সকালে রমনা, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমি ইত্যাদি এলাকা ঘুরে মনে হয়েছে, জঙ্গিবাদের থাবা কিংবা দুর্বৃত্তের লাগানো আগুন মানুষের প্রাণের স্ফূর্তিকে থামিয়ে দিতে পারে না।


নববর্ষে সব শ্রেণি ও বয়সের নারী-পুরুষ নতুন পোশাক পরে উৎসবে যোগ দিয়েছেন। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ । এক অনুষ্ঠান থেকে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। রমনা-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুধু গানের আয়োজন ছিল না, দোকানিরা নানা পসরাও সাজিয়ে বসে ছিলেন। কোনো গোলমাল হয়নি। সবাই প্রাণভরে নববর্ষকে উদ্‌যাপন করেছেন। কোনো ক্লান্তি নেই। কোনো বিরক্তি নেই। শুধু এই এলাকা নয়, পুরো ঢাকা শহরই উৎসবের আমেজে ভরপুর ছিল। আগে সারা শহরের লোক রমনায় ভেঙে পড়ত। এখন প্রায় প্রতিটি পাড়ায়–মহল্লায় নববর্ষের আয়োজন।


এবারে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে শেরেবাংলা নগরে সুরের ধারা আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সফররত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংও। নব্বইয়ের দশকে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ফলে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও বাংলা নববর্ষের সঙ্গে তিনি আগেই পরিচিত। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী পান্তা-ইলিশ খাওয়ার গল্প শোনালেন সবাইকে।

নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ছবি: প্রথম আলো
নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ছবি: প্রথম আলো

এবারে আনন্দের খবর হলো দেশের সবখানে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে নববর্ষ উদ্‌যাপিত হয়েছে। কোনো অঘটন ঘটেনি। প্রথম আলোর অনলাইনের সাংবাদিক বন্ধুরাও বললেন, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোনো অঘটনের খবর তাঁরা পাননি। সবকিছু সুন্দরভাবে চলেছে। মানুষ মেতেছে আনন্দ-উল্লাসে।


নববর্ষে আমরা পাঠককে আনন্দের খবর দিতে চাই। তাঁদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই।


বাংলাদেশ সত্যি সত্যি শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ হোক। সমাজ থেকে হিংসা ক্লেদ মুছে যাক। সবার জীবন নিরাপদ ও আনন্দময় হোক। হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার বাণী, সরব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ আরও জোরালো হোক। রমনা বটমূল থেকে তা ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।