নুসরাত, তুমি কি জানো?

নুসরাত
নুসরাত

প্রিয় নুসরাত, তুমি চলে গিয়েছ না-ফেরার দেশে। নাহ, ভুল বললাম। তোমাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে না-ফেরার দেশে। তুমি সেখানে যেতে চাওনি মোটেই। তবু চলে যেতে হয়েছে। তুমি বারবার বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলে। কিন্তু এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এতটাই নিষ্ঠুর যে ওরা তোমাকে বাঁচতে দেয়নি। সবাই বলছে, তুমি নাকি মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছ। এই সমাজ এভাবেই বলে বারবার। রূপা আর তনুকেও ওরা একইভাবে বলেছিল। কারণ, এই সমাজের অনেকে নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার নারীকে দেখতে নারাজ। তুমি বেঁচে গিয়েছ কি না জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, এইভাবে মরে গিয়ে কেউ বাঁচতে চায় না। তবে তুমি কি জানো, তোমার অঙ্গার হয়ে যাওয়া মেহেদিতে রাঙানো লাবণ্যময় পা দুখানা আমাদের হৃদয়কে অঙ্গার করে দিচ্ছে। আগুনে ঝলসে যাওয়া তোমার এই পা দুটির অলৌকিক ক্ষমতার কথা কেউ কি আগে কখনো জানত?

নুসরাত, তুমি কি জানো, আমরা আজকাল ‘ধর্ষিতা’ কিংবা ’নির্যাতিতা’ শব্দগুলো আর বলি না! আমরা ইদানীং বলতে শিখেছি ‘ধর্ষণের শিকার’ কিংবা ’নির্যাতনের শিকার’ নারী। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি? নারী বারবারই শিকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে অথচ শিকারির সাজা কি সব সময় নিশ্চিত করা যায়? তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর প্রভাবশালীরা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তাদের মুক্তির দাবিতে বিবেকহীন একদল জনতা নির্লজ্জ মিছিল করে। অথচ তাদের থাবার আঘাতে জর্জরিত শিকারগুলো একবার নয়, বারবার মরে।

তুমি জানো কি না জানি না, এই দেশের প্রায় প্রতিটি নারী প্রতিটি দিন, প্রতিটি পদক্ষেপে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, তখনো পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রতিটি দিন লক্ষ করেছি ষন্ডা মার্কা বখাটে ছেলেটিকে, যে স্কুলে যাওয়ার পথে রোজ আমার পিছু নিত। পরীক্ষার্থী না হয়েও সেই ছেলেটি পরীক্ষার হলে কীভাবে ঢুকত, তা ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়। আমি তখন হলে বসে পরীক্ষার পড়া নয়, বরং আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে অপেক্ষা করতাম কখন শিক্ষক পরীক্ষার হলে ঢুকবেন। এই সমাজ কি জানে আমার সেই উদ্বিগ্নতার গুরুভার? এইচএসসি পরীক্ষাতেও ঘটেছিল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধু পরিবর্তন ঘটেছিল মূল চরিত্রের। মা-বাবা ভয় পেতেন কখন অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হবে কিংবা তুলে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁদের আদরের মেয়েটিকে। মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই অনেক দিন মাথা ঢেকে পৌঁছে যেতাম কলেজে। এভাবে কত নষ্ট বখাটেদের পাশ কাটিয়ে চলতে হয়েছে জীবনের পথ! সেই পথচলা কিন্তু আজও শেষ হয়নি। আজও আমি নির্যাতনের শিকার হই, ব্যথিত হই, অপমানিত হই গণপরিবহনে, পারিবারিক পরিবেশে, উন্মুক্ত রাস্তায়, সহকর্মীদের আড্ডায়, ওয়াটসআপ, ভাইবার কিংবা মেসেঞ্জারের চ্যাটবক্সে। কত ছদ্মবেশী দুশ্চরিত্রের দল আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। জানি, এসবের প্রতিবাদ করতে গেলেই সমাজ আমার দিকেই আঙুল তুলবে। প্রশ্ন করবে আমার পেশা, পোশাক, চলা, হাসা, কথাবার্তা বলা নিয়ে। বলবে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে, মেসেঞ্জারসহ নানা অ্যাপসকে বিদায় জানাতে।

আজ তোমার যা পরিণতি, সেই পরিণতি হওয়ার কথা এই সমাজের প্রতিটি মেয়ের, প্রতিটি নারীর। একবার ভেবে দেখো তো গণপরিবহনে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ৯০ শতাংশ নারী, প্রতিবছর ধর্ষণের শিকার হওয়া হাজার হাজার নারী ও কন্যাশিশু, গার্মেন্টস আর পথেঘাটে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া ৭০ শতাংশ নারী কিংবা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়া ৭০ শতাংশ নারী যদি রোজ প্রতিবাদ জানাত, তবে কী পরিণতি হতো বাংলাদেশের! তাহলে কি অশান্তির আগুন আরও বেশি করে জ্বলত? নাকি নারীর জন্য আরও নিরাপদ হতো দেশ, সমাজ ও পরিবার? নীরব থেকেও নারীরা কি আগুনের উত্তাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে! আমাদের হৃদয়-মন পুড়ে অঙ্গার, সেই খবর কি কেউ রাখে? আর কত সয়ে যাব আমরা! আর তো পারি না।

নুসরাত, তুমি প্রতিবাদ করেছিলে। অভিবাদন তোমাকে। তুমি বুঝতে পারো কি না জানি না, তোমার শরীরের পোড়া মাংসের গন্ধ আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। জানি, এই গন্ধে প্রতিবারের মতো এবারও ঢেলে দেওয়া হবে এয়ার ফ্রেশনার কিংবা সুগন্ধি আতর। তাতে সাময়িকভাবে পোড়া গন্ধটা হয়তো কেটে যাবে। তবে ছাইয়ের নিচে পুড়তে থাকা অঙ্গার দ্বিগুণ, তিন গুণ, বহুগুণ অভিশাপ নিয়ে ফিরে আসবে বারবার। সবাই বলছে, তুমি নাকি ‘আগুনকন্যা’! তবে যে দেশের কর্তাব্যক্তিরা জেগে জেগে ঘুমায়, তাদের ঘুম তোমার আগুনের উত্তাপেও ভাঙবে কি! প্রিয় নুসরাত, তুমি আমাদের অভিশাপ দাও। আরও আরও বেশি অভিশাপ দাও। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতাটুকুও যে আজ আমরা হারিয়েছি।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]