সাংবাদিকদের 'সেলফ-সেন্সরশিপ'

গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব)-এর নতুন কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার একটি বক্তব্য জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘কোন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা যাবে, কতটা প্রকাশ করা যাবে, সরাসরি সম্প্রচার কতটা করা যাবে, এ বিষয়গুলো সাংবাদিকদের একটা সেলফ-সেন্সরশিপের আওতায় আনা উচিত।’ তাঁর এই বক্তব্য আমাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

গণতান্ত্রিক সমাজের দাবি, সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করবে। সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে, এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ নেবে না। তাই সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা, আইনকানুন–বিধিনিষেধের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা খর্ব করা জনসাধারণের বিবেচনায় অত্যন্ত আপত্তিকর বিষয়। সরকারি সেন্সরশিপের চেয়েও বেশি আপত্তিকর ও নিন্দনীয় ব্যাপার ঘটে, যখন সাংবাদিকেরা নিজেরাই নিজেদের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেন। এর ফলে সংবাদমাধ্যমের ওপর জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পায়। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার মূল শক্তি জনসাধারণের আস্থা; সংবাদমাধ্যমকে তা অর্জন করতে হয় তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে, সর্বসাধারণের স্বার্থে সঠিক সংবাদ যথাসময়ে পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে। তাই সংবাদমাধ্যমের ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ সরকারের আরোপ করা সেন্সরশিপের মতোই অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা। অবাধ তথ্যপ্রবাহের জন্য উভয় ধরনের নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও সমাজের সর্বজনীন কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যেহেতু গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য, সাংবাদিকতা একটি ‘সেলফ-রেগুলেটেট’ বা স্বনিয়ন্ত্রিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত। সেলফ-রেগুলেশন একটি স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়, এটা সেলফ-সেন্সরশিপের বিপরীত। দেশের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনকানুনের আলোকে এবং জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার স্বার্থে সাংবাদিকেরা সম্মিলিতভাবে নিজেদের আচরণবিধি তৈরি করেন এবং তা যথাযথভাবে মেনে চলার সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এটা পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিশ্চিত করার বিষয়। এটাই সেলফ-রেগুলেশন বা স্বনিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সেলফ-সেন্সরশিপের প্রবণতা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এর সঙ্গে ভীতি, চাপ ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাবের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পর্ক থাকে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখন এক প্রতিকূল সময় অতিবাহিত করছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর আইনের কিছু ধারা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে; রাজনৈতিক ও ক্ষমতাধর বিভিন্ন মহলে সংবাদমাধ্যমের প্রতি অসহিষ্ণুতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ রকম পরিবেশে ডিএমপি কমিশনার যখন সাংবাদিকদের সেলফ-সেন্সরশিপের কথা বলেন, তখন বিদ্যমান ভীতি-সংশয়ের পরিবেশে বাড়তি হুঁশিয়ারি যুক্ত হয়। এতে সাংবাদিকদের কাছে একটা নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে থাকতে পারে।

অবশ্য সরেজমিনে খবর সংগ্রহের সময়ে, আলোকচিত্র ও ভিডিও চিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং সম্প্রচারমাধ্যমে কোনো ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে সাংবাদিকতার অবশ্যমান্য রীতিনীতিগুলো যথাযথ অনুসরণে সব সংবাদকর্মী যে সমানভাবে সচেতন বা সতর্ক থাকেন, তা বলা যায় না। এ বিষয়ে আরও সচেতনতা প্রয়োজন। তবে এসব বিষয়ও সংবাদপ্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে স্বীকৃত। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, ডিএমপি কমিশনারের সেলফ-সেন্সরশিপের পরামর্শ দেওয়া কতটা শোভনীয় হয়েছে। আমরা বরং আশা করব, পুলিশ বিভাগসহ সরকারি-বেসরকারি সব কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করবে।