ভারতের ভোটযুদ্ধে বাংলাদেশ

ভারতজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া
ভারতজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া

বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠ বরাবর গরম থাকে। কিন্তু গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল একপেশে হওয়ার পর থেকেই রাজনীতিতে রীতিমতো শৈত্যপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। দেশব্যাপী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন মোটেও উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।

কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির রাজনীতির আঁচ আমরা বেশ টের পাচ্ছি। ভারতজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। ওদেশে লোকসভার নির্বাচন হচ্ছে সাত ধাপে। পয়লা ধাপ ইতিমধ্যেই শেষ। ভারতীয় গণমাধ্যমে এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ, আলোচনা, বিতর্ক এবং ঝগড়াঝাঁটির অন্ত নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের সঙ্গে ওদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু ব্যাপারে অমিলও আছে।

একসময় মিজোরাম থেকে খাইবার পাখতুনখাওয়া, অরুণাচল থেকে বেলুচিস্তানজুড়ে বিস্তৃত ছিল একই দেশ। দুই ধাপে এটি তিন টুকরো হয়েছে। টুকরো হলে কী হবে, শত শত বছর একসঙ্গে ঘর করার ইতিহাস আছে, আছে অনেক তিক্ত ও মধুর স্মৃতি। নানা রঙের জাতীয়তাবাদের বলি হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। পুরোনো ইতিহাসের আকর্ষণ-বিকর্ষণের কারণেই এক দেশের ঘটনা অন্য দেশকে ভাবায়, আলোড়িত করে। তাই কারণে-অকারণে এক দেশের রাজনীতিতে অন্য দেশকে টেনে আনা হয়। অর্থাৎ আলাদা হয়েও আলাদা থাকা যাচ্ছে না।

ভারত ভেঙে যখন পাকিস্তান হয়, তখন এক ধরনের জাতীয়তাবাদ মানুষকে মোহাবিষ্ট করেছিল। পাকিস্তান ভেঙে যখন বাংলাদেশ হয়, তখন জাতীয়তাবাদের ধরন বদলে গিয়েছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেমে থাকেনি। জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে যখন একটি ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ তৈরি হয়ে যায়, তখন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন তেমন থাকে না, এটাই হতে পারত স্বাভাবিক রীতি।

কিন্তু তা হয়নি। রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের তাতে কী ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে, তার হিসাব কষা অনেকেই জরুরি মনে করেন না। জাতীয়তাবাদ শাসকগোষ্ঠীর কাছে পরম আদরের একটি ভাবাদর্শ। এটি দিয়েই নানা রকমের সাফাই গাওয়া যায়।

পাকিস্তানের ২৩-২৪ বছর আমাদের হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে। শেষ অবধি শুনতে হয়েছে, পাকিস্তান শিশু রাষ্ট্র। কোনো রকমের সমালোচনা বা প্রতিবাদ হলেই শাসকগোষ্ঠীর কাছে শুনতে হতো, রাষ্ট্র বিপন্ন। সমালোচকেরা ছিলেন রাষ্ট্রের শত্রু, দেশদ্রোহী। ঔপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোর প্রায় সব কটিতেই একই ধরনের প্রবণতা। রাষ্ট্র যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে পরম পূজনীয় এক নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। তাই রাষ্ট্র নিয়ে কায়কারবার কেবল রাষ্ট্রের অভিভাবকদের। আমজনতার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। শাসকগোষ্ঠী বিপদে পড়লেই রাষ্ট্রের ওপর তার দখলদারত্ব বাড়িয়ে দেয়।

ভারতের হালফিল ছবিটা এ রকমই। তার আগে একটি প্রসঙ্গ না তুলে পারছি না। যাঁদের হাত ধরে ভারত স্বাধীন হয়েছিল, সেই প্রজন্মটি এখন আর নেই। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা তাঁদের রাষ্ট্রটি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। যখন লড়াইটা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে, তখন অবস্থা ছিল এক রকম। ঔপনিবেশ-উত্তর সময়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বহাল রাখার জন্য একটা শত্রু চাই। ভারত সেই শত্রুর সন্ধান পেয়েছে পাকিস্তানের মধ্যে। এমনকি বাংলাদেশও এই শত্রু শত্রু খেলার বাইরে নেই। যখন যে রকম সুবিধা, তখন সে রকম কার্ড ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের আশপাশের রাজ্যগুলোর রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি বড় ফ্যাক্টর। বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং পশ্চিমবঙ্গে ‘অবৈধ অভিবাসন’ হচ্ছে—এই আওয়াজ তুলে বিজেপি এই রাজ্যগুলো কবজা করতে চাইছে। ইতিমধ্যে তারা মেঘালয় ও ত্রিপুরায় থাবা বসাতে সক্ষম হয়েছে। আসামেও তাদের বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। আর সারা ভারতে তো আছেই পাকিস্তানি জুজু।

বিজেপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে খোলাখুলিই বলছেন, তাঁর ডকট্রিন হলো ‘রাষ্ট্রবাদ’। এ এমন এক বস্তু যা দিয়ে মানুষের মধ্যে খুব সহজেই উন্মাদনা জাগিয়ে তোলা যায়। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মন্তব্য করেছেন, নরেন্দ্র মোদি আবারও নির্বাচিত হলে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পাকিস্তানের অসুবিধা হবে না। ইমরান হয়তো বুঝতে পেরেছেন, হাওয়া কোন দিকে বইছে। তাই তিনি আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছেন যে, তাঁর ওপর ভরসা করা চলে।

এই বিষয়টিকেই পুঁজি করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে এই বলে বোমা ফাটাচ্ছেন যে, মোদিকে সমর্থন করার অর্থ হলো পাকিস্তানকে সমর্থন করা। পাকিস্তানবিরোধী জিগির তুলে নির্বাচনী সাঁকো পার হতে মরিয়া দুটো দলই।

কিছুদিন আগে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হন। মোদি সরকার এ জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। ১৬ কোটি নতুন ভোটারের উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদির আহ্বান, আপনারা আপনাদের জীবনের প্রথম ভোট কাশ্মীরে নিহত সেনা এবং বালাকোটকে স্মরণ করে উৎসর্গ করুন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদির প্রচার ছিল উন্নয়ন আর কর্মসংস্থান নিয়ে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, ভারতে বেকারত্বের হার আগের তুলনায় বেড়েছে অনেক। মোদির এখন মূল স্লোগান, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দিতে হবে এবং তিনিই এটা পারবেন। তিনি বলেছেন, ‘ম্যায় ভি তো চৌকিদার হু’ (আমিও তো চৌকিদার/পাহারাদার)। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাহুল প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ (চৌকিদার চোর)। মোদি পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, চোর বাস করে তুঘলক রোডে। উল্লেখ্য, রাহুলের বাসা নয়াদিল্লির তুঘলক রোডে এবং সেখান থেকে সম্প্রতি ২০ কোটি রুপি অন্য এক কংগ্রেস নেতার কাছে সরানোর অভিযোগ উঠেছে।

রাষ্ট্রবাদী প্রচারে রাহুলও কম যান না। একটি টিভি বিজ্ঞাপনচিত্রে রাহুল সম্পর্কে গানে গানে বলা হচ্ছে, ‘ম্যায় হি তো হিন্দুস্তান হু’ (আমিই তো হিন্দুস্তান)। ভারত এখন উগ্র জাতীয়তাবাদী বাকোয়াজদের খপ্পরে পড়েছে।

ভারতের শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা যে ভাষায় একে অপরকে আক্রমণ করছেন, তার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কারণ, একই ভাষায় আমাদের নেতারাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চান। একে অপরকে চোর, খুনি, দেশদ্রোহী বলেন। অন্য দেশের দালাল বলেন। এখানের রাজনীতিতে কেউ পাকিস্তানের দালাল, কেউ ভারতের দালাল। সত্তরের দশকে ‘সিআইএ’ আর ‘কেজিবি’র কথা হরহামেশা শোনা যেত। এখন দেশটা যেন ‘আইএসআই’ আর ‘র’-এর এজেন্টে ভরে গেছে। এ ধরনের প্রচারের মাধ্যমে ভোটারের মন তুষ্ট করে নিজের পক্ষে টানা এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলার আয়োজন চলছে গত কয়েক দশক ধরে।

ভারতের নির্বাচনে কে জিতবে, কে হারবে, সেটা সে দেশের নাগরিকেরাই ঠিক করবেন। কিন্তু যিনি বা যাঁরাই জিতুন-হারুন, তা পড়শি হিসেবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলবে। এ দেশে আওয়ামী লীগের সরকার আছে টানা ১০ বছর। এটা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এত দিন আমাদের ধারণা ছিল, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য বেশি। পরে দেখা গেল, নরেন্দ্র মোদির সরকারের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো বলে উভয় দেশের সরকারই দাবি করছে।

যুদ্ধের উন্মাদনা তুলে এবং সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে মোদি ভোটযুদ্ধে জয়ী হতে চান বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন হলো ‘হিন্দুত্ববাদ’। এটি বাংলাদেশের ঘোষিত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চেতনার সঙ্গে যায় না। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক ভিন্ন জিনিস। যদি মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সরকারের সমীকরণটা কেমন হবে, তা নিয়ে আশা এবং আশঙ্কা দুটোই আছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো জটিল সমস্যার এখনো মীমাংসা হয়নি। নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে তার কতটুকু সমাধান হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। এটা অবশ্য বলা যায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে, যখন ভারতে অকংগ্রেসী সরকার ছিল।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi [email protected]