তাজউদ্দীনের প্রজ্ঞায় সফল যে সরকার

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ

আজ ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনার জন্য ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই ঐতিহাসিক দিনে।

লাখো মানুষের রক্ত ও আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এর নানা পর্ব ছিল। সেই সব পর্বে যে যার দায়িত্ব পালন না করলে তা অর্জন করা যেত না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য দিগন্তছোঁয়া প্রেরণা। স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা বন্দী করার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধপর্ব। তাঁর অবর্তমানে এই চূড়ান্ত পর্বের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন ছয় দফার অন্যতম রূপকার, অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর নিকটতম সহচর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে ব্যারিস্টার আমীর–উল ইসলামের সঙ্গে তিনি বের হয়েছিলেন দেশের মুক্তির পণ নিয়ে।

৩০ মার্চ কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী টুঙ্গি গ্রামের এক সেতুর নিচে আত্মগোপনকারী তাজউদ্দীন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, একটি স্বাধীন সরকার গঠন করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করার। তাঁর ওই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও সুদক্ষ নেতৃত্বের ফসল ছিল ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার; বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেওয়া এক নতুন বাংলাদেশ; লাখো মানুষের আত্মত্যাগের নকশিতে গড়া এক উদ্দীপ্ত পতাকা।

 তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর–উল ইসলাম ভারতে প্রবেশ করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিনিধি রূপে। ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তাজউদ্দীন আহমদ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে স্বাধীনতাযুদ্ধ বাংলাদেশের জনসাধারণের যুদ্ধ, এই যুদ্ধে তারা ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও তারা চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্রশক্তি এবং সে বাংলাদেশকে গণ্য করবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।

১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় শিলিগুড়ির জঙ্গলের গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দিকনির্দেশনাপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচারিত হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।

১১ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এমপি আবদুল মান্নানের খোঁজ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের তুরা পাহাড়ের কাছে ডাকোটা প্লেন থেকে নেমে তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে আলাপ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। সব শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান এবং সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ মত দেন। তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সন্ধানও পাওয়া যায়। অর্থমন্ত্রী হন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গেও তাজউদ্দীন আহমদ আলাপ করেন। প্রথাগত যুদ্ধের বিপরীতে জনযুদ্ধকে গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন।

১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সূচিত হয় নয়া ইতিহাস। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর সামনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সূচিত হয়। সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্যের এক অংশে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।...সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত–পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।’

অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী।

জাতির চরম দুঃসময়ে এক নির্মোহ ও নিঃস্বার্থ সাধকের মতোই তাজউদ্দীন হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের। বাইরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ, ভেতরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের পাকিস্তান ও সিআইয়ের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র বা মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে মুজিব বাহিনী গঠনের চেষ্টার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাজউদ্দীন আহমদকে। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐক্য বিনষ্টকারী এসব নানামুখী তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র তিনি বানচাল করেন তাঁর ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে। খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যোগ দান করে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিও তাঁকে ছাড়তে হয়। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্বও তিনি সামাল দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদের বড় অর্জন ছিল: ১. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, যেদিন বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বলবে, সেদিন তারা সৈন্য উঠিয়ে নেবে—এই শর্তগুলোর উল্লেখ ও বাস্তবায়ন। ২. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে জাতির জনকের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করে তাঁকে মুক্ত স্বদেশে ফিরিয়ে আনা।

এই বিষয়গুলো স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে নেই। তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সঠিক মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আজও হয়নি। ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষটি আজ পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। এই দুর্ভাগ্য তাঁর নয়, দুর্ভাগ্য এ জাতির। যে জাতি নিজের ইতিহাস জানে না, সে আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়তে পারে না।

তারপরও আশা থাকবে, নতুন প্রজন্ম একদিন সব ধরনের ক্ষুদ্রতা, অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চেতনার নবজাগরণ ঘটাবে; চেতনার নিষ্কলুষ বিকাশে জন্ম নেবেন তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মতো সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক নতুন শিশু। তারা বাংলাদেশকে পথনির্দেশ করবে আলোর পথে।

শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা