আমাদের তরুণ বিজ্ঞানীরা

ইউরি গ্যাগারিন
ইউরি গ্যাগারিন

গতকাল অনুসন্ধিৎসু চক্রের আমন্ত্রণে একটি আলোচনা সভায় অংশ নিই। আলোচনার বিষয়টি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি ছিল মহাশূন্যে মানুষের প্রথম যাত্রা স্মরণে। ৫৮ বছর আগে, ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণ করেন। মহাকাশে তিনিই হলেন প্রথম মানব অভিযাত্রী। তিনি মহাকাশে ছিলেন ১০৮ মিনিট। মাত্র দেড় ঘণ্টার মতো সময়ে তিনি পৃথিবীকে একবারের সামান্য বেশি প্রদক্ষিণ করেন এবং সুস্থ ও সুন্দরভাবে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ভাস্তোক–১ নভোযানে তিনি মহাকাশে যান। দিবসটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য জাতিসংঘ উদ্যোগ নিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের সবার জন্য উদ্দীপনামূলক বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশের কতজন এর তাৎপর্য উপলব্ধি করে?

তরুণদের বিজ্ঞান সংগঠন অনুসন্ধিৎসু চক্র উদ্যোগ নিয়েছে আলোচনার। ইএমকে সেন্টার ও মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা সহযোগিতা দিয়েছে। বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে আমি সেখানে আলোচনার বিরল সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ প্রজন্মের অভাবনীয় উদ্যোগ না থাকলে হয়তো মানব প্রজাতির মহাশূন্য জয়ের সূচনার কথাটি আমাদের মনেই থাকত না।

অবশ্য গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিশ্ব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই পরাশক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা নয়, কে স্নায়ুযুদ্ধে একে অপরকে পরাজিত করে এগিয়ে যাবে, সেটাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু এখন আমরা দিবস পালন করছি বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য হিসেবে। আর তরুণ প্রজন্ম বিগত শতাব্দীর ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সংকীর্ণতা কাটিয়ে আজ বিজ্ঞানের দিকটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এটাই বড় কথা।

কেউ ভাবতে পারেন, রকেটে একজন মহাকাশে গিয়েছেন, চাঁদে গিয়েছেন, তার ইতিহাস তো কমবেশি সবাই জানে। আর আজ রকেট যাচ্ছে মঙ্গলে, বৃহস্পতিতে। এর মধ্যে আবার এত কিছু আলোচনার কী আছে?

আসলে ইতিহাস তো নিশ্চয়ই আমাদের জানতে হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা গ্যাগারিনের মহাকাশ অভিযাত্রা বিজ্ঞান ও মানবসভ্যতাকে কীভাবে কতটা এগিয়ে নিল, সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা।
মহাকাশ পরিভ্রমণের রোমাঞ্চকর নানা তথ্য সেদিনই মানুষ প্রথম জানল। মহাশূন্যে গ্যাগারিনের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানীদের মহাকাশ জয়ের পরবর্তী পথরেখা তৈরি করে। তিনি মহাকাশ থেকে রেডিও সংকেতের মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। অবশ্য প্রথমে একটি নোট খাতায়ও তাঁর অভিজ্ঞতা লিখে রাখছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দেখেন পেনসিল ভেসে চলে গেল তাঁর চেয়ারের কোনো ফাঁকে। সেই পেনসিল তিনি আর খুঁজেই পেলেন না। ১০৮ মিনিটের মহাজাগতিক জীবনের এই সাড়া জাগানো ঘটনাটি ছিল মহাশূন্য জয়ের প্রথম সোপান। গ্যাগারিন ছিলেন মহাশূন্যে মানব প্রজাতির প্রথম প্রতিনিধি। সারা বিশ্বে তখন তিনি নায়ক! সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।

অথচ এই গ্যাগারিন ছিলেন গ্রামের একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান। শ্রমিকের কাজ শুরু করেছিলেন। পরে ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য হন। প্যারাস্যুট জাম্পিংয়ে তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি সবার নজর কাড়েন। হাজার হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে বাছাই

হয়ে তিনি মস্কো থেকে মহাশূন্যে প্রথম নভোচারী হওয়ার আমন্ত্রণ পান। এরপর মহাশূন্যে প্রথম মহিলা ছিলেন ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা। তিনি ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন মহাশূন্যে যান এবং ৭১ ঘণ্টায় কক্ষপথে ৪৮ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। মহাশূন্যে প্রথম নারীর এই অভিযাত্রা সে সময় সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়। আবারও প্রমাণিত হয়, নারী-পুরুষ সর্বক্ষেত্রে সমান।

গ্যাগারিন ছিলেন প্রথম মহাকাশচারী। কিন্তু এর পেছনে ছিল শত শত বিজ্ঞানীর বেশ কয়েক বছরের গবেষণা ও উদ্যোগ। গ্যাগারিনকে মহাশূন্যে

পাঠানোর আগে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন।

এর প্রথমটি ছিল মহাকাশে স্পুৎনিক পাঠানো। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে স্পুৎনিক পাঠায়। একটি ছোট্ট গোলকের সমান কৃত্রিম উপগ্রহ। ব্যাস ২ ফুটের কম, প্রায় সাড়ে ৮৩ কিলোগ্রাম ওজন, মাত্র ৯৮ মিনিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে উপবৃত্তাকার পথে।

এটি ছিল মহাজাগতিক যুগের সূচনার সংকেত। ইতিহাস বদলে দেওয়া পদক্ষেপ। স্পুৎনিক পাঠানোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্বাকাশে আয়নস্ফিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ। চাপ ও তাপ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ। কক্ষপথ পরিভ্রমণের সময় কতটা পেছন টান আসে, সেটাও জেনে নেওয়া। মহাশূন্যে মানুষ যাওয়ার আগে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জানা অপরিহার্য ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে স্পুৎনিক পাঠিয়েছে, এ ঘটনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। পরের বছর ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আমেরিকাও মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার ওয়ান পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠায়। শুরু হয় স্পেস রেস।

কিন্তু তার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। তাদের চিন্তা ছিল, মহাশূন্যে মানুষ পাঠানোর আগে পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে সেখানে কোনো প্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব কি না। তাই স্পুৎনিক মহাকাশে পাঠানোর পরের মাসেই, ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে প্রথম প্রাণী পাঠায়। সেটি ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কুকুর, নাম লাইকা। লাইকা অবশ্য মহাশূন্য থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারেনি। কিন্তু কোনো প্রাণীর মহাশূন্যে যাওয়ার অনুকূল শর্তের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিল।

এরপর আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। এই মুন রেসে আমেরিকা এগিয়ে যায়। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন চাঁদে নামেন।

এখন বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছেন, মহাশূন্যে মানুষের ওপর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি নাসা মহাশূন্য স্টেশনে স্কট কেলির ৩৪২ দিন (২০১৫-১৬) পরিভ্রমণের সময় তাঁর শরীর-মনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানার জন্য গবেষণা চালায়। এই গবেষণার পদ্ধতিটি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। নাসা স্কট কেলির স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁর মহাকাশ পরিভ্রমণের সময়কালে পৃথিবীতে অবস্থানরত তাঁর আইডেন্টিক্যাল টুইন ব্রাদার মার্কের সঙ্গে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে।

কেলির একটি মজার প্রতিক্রিয়া এখানে উল্লেখ করছি। কেলি বলেন, মহাকাশ পরিভ্রমণের সময় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুপস্থিতির কারণে মাথায় বেশি রক্ত জমা হতো, পায়ে রক্ত সরবরাহ কম হতো। সব সময় তিনি মাথায় একটা চাপ অনুভব করতেন। অবশ্য পৃথিবীতে ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। পৃথিবী পরিভ্রমণের সময় চোখের দৃষ্টিতেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। একে বলা হয় স্পেস ফ্লাইট রিলেটেড নিউরো অকুলার সিনড্রোম—চোখে দেখার সমস্যা। এসব বিষয়ে আরও জানার জন্য পড়ুন সায়েন্টিফিক আমেরিকান বিজ্ঞান সাময়িকীতে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল প্রকাশিত জিম ডেলির লেখা এই লিংকে: https://www.scientificamerican.com/article/tests-on-astronaut-and-twin-brother-highlight-spaceflights-human-impact/।

আজ দেশের তরুণেরা বিজ্ঞান নিয়ে এত কিছু কাজ করছেন। বিজ্ঞান উৎসবের আয়োজন করছেন। স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলছেন। বিজ্ঞানসচেতনতা বাড়ছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে!

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]