নটর ডেম ক্যাথেড্রাল আগের মতো হবে না

জ্বলছে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সুউচ্চ চূড়া। ফ্রান্স, ১৫ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স
জ্বলছে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সুউচ্চ চূড়া। ফ্রান্স, ১৫ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স

‘তুমি এখনো নটর ডেমের পশ্চিম দিকটা দেখনি’, ঠাট্টা করে কথাগুলো বলেছিলাম আমার বাবাকে। আমার মা, যিনি কিনা একজন ইতিহাসবিদ এবং গোথিক স্থাপত্যের প্রতি প্রবলভাবে আচ্ছন্ন। আমাদের প্রথমবারের মতো যখন প্যারিসের সেই আইকনিক নটর ডেম ক্যাথেড্রালে নিয়ে গেলেন, তখন সেখানে শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন। তাঁরা ক্যাথেড্রালের সামনের অংশের বহু বছরের জমে থাকা ধুলোময়লা ঝাড়ছিলেন। তাঁরা একটি গাঢ় ধূসর রঙের পাথরকে এমনভাবে ঘষামাজা করছিলেন যে তা প্রায় সাদা মনে হচ্ছিল। এর কয়েক বছর পর আমার মা, আমার বোন ও আমি প্রাসাদোপম আলোকময় ওই ক্যাথেড্রালে যাই। কাজ থাকায় বাবা যেতে পারেননি। আর আমরা সেটাই ঠাট্টার ছলে তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দিই।

ক্যাথেড্রালের সামনের অংশে দেখলাম জুদাহ রাজবংশের ২৮ জন রাজা নাটকীয়ভাবে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। মানে এগুলো তাঁদের মূর্তি। ফরাসি বিপ্লবের সময় মূর্তিগুলোর মাথা ভেঙে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। উনিশ শতকে নতুন করে আবার মূর্তিগুলো স্থাপন করা হয়। মানুষ তার উদ্ভাবন কুশলতা দিয়ে এটি তৈরি করেছে। আবার মানুষই এর ক্ষতিসাধন করেছে। পুরোনো এবং সুন্দরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে মানুষই আবার এর সৌন্দর্য
উদ্ধার করেছে।

গির্জাটির অপরূপ সাজসজ্জা ভালোভাবে দেখার জন্য আমরা এর ছাদে উঠি। লম্বা ও ধূসর রঙের ছাদটি অতিক্রম করে যাওয়া যায় গির্জার অলংকৃত চূড়ায়। এর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখার মতো। গির্জার খিলান ও বাইরের অংশ গোথিক শিল্পশৈলীতে তৈরি। ছাদের ওপরে থাকা মূর্তিগুলো সময়ের আবর্তনে উজ্জ্বল সবুজ রং ধারণ করেছে। এগুলো মূলত তামার মূর্তি ছিল। অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে তা সবুজ রং ধারণ করেছে।

সোমবার আরেকটি অপ্রতিরোধ্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার ঘটনা ঘটেছে নটর ডেমের ছাদে এবং আরও অনেক স্থানে। আমার স্মৃতিতে যা আছে, সেগুলো অবশিষ্ট আছে কি? সোমবার দুপুরে আমার মা আমাকে বার্তা পাঠান, যাতে লেখা ছিল, ‘কষ্টদায়ক ও মর্মস্পর্শী’। গির্জার চূড়াটি একেবারে ধসে পড়েছে। ফরাসি কর্মকর্তারা সোমবার দুপুরে বলছিলেন আগুনে গির্জাটির কতখানি ক্ষতি হয়েছে।

কেন মানুষ কোনো প্রাচীন নিদর্শনের ধ্বংসে এ রকম আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে? ইসলামিক স্টেটের আক্রমণে প্রাচীন পালমিরা শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মানুষ যতটা দুঃখিত হয়েছিল, অগণিত সিরীয় নাগরিকের মৃত্যুতে ততটা দুঃখ তাদের হয়নি।

পুরোনো জিনিস সুন্দর হতে পারে। সেগুলো মাঝেমধ্যেই অনন্য হয়। কিন্তু নটর ডেম ক্যাথেড্রাল সুন্দর ও অনন্য—দুটিই। এটা আবারও গড়ে তোলা হবে। কিন্তু যেসব শিল্পীর হাতের ছোঁয়ার এই গির্জা সুন্দর ও অনন্য হয়ে উঠেছিল, তাঁদের মতো করে কেউ পারবে না বলেই মনে হয়। আসল কথা হচ্ছে, গোথিক শিল্পশৈলীতে কেউ আর কিছু গড়তে পারবে না।

আমরা এখনো নটর ডেমের প্রাচীনত্বকেই পছন্দ করছি। প্রাচীন ভবনগুলো আমাদের মনে এই ধারণার জন্ম দেয় যে শত শত বছরের ঐতিহ্য শেষ হয়ে যায়নি। আর এ জন্য যখন প্রাচীন কোনো কিছু পুড়ে যায়, তখন আমরা সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করি, এমনকি তাঁরা যদি সত্যিকারের ২৮ জন রাজা না–ও হন।

না, নটর ডেম মরে যায়নি। গির্জাটি আবার গড়ে উঠবে। এটা আরেকবার সুন্দর হয়ে উঠবে। এর চূড়া আগের মতোই কারুকার্যময় হবে। তবে যা–ই হোক না কেন, এটা ঠিক আগের মতো হবে না। সোমবার পর্যন্ত আমি এটা অনুধাবন করতে পারিনি যে আমি আমার ভবিষ্যৎ সন্তানদের গির্জাটির সৌন্দর্য দেখানোর জন্য কতখানি উদ্‌গ্রীব হয়ে ছিলাম যে সৌন্দর্য আমি আমার ১১ বছর বয়সে দেখেছিলাম, যা আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। তাদের নিশ্চয়ই আমি রোজ উইন্ডো দেখাতাম, যেগুলো কিনা ছিল লাল ও নীল রঙের। আমি আমার সন্তানদের এটা বলতাম যে মধ্যযুগের শিল্পীরা এ ধরনের গাঢ় রং তৈরি করার জন্য রাসায়নিকের সঠিক ব্যবহার করতে পারতেন।

আমি এখনো জানি না, সেই রঙিন রোজ উইন্ডোর কাচগুলো পুড়ে গেছে কি না। আশা করছি পোড়েনি। আমি চাই, নটর ডেমের সৌন্দর্য দেখে আমার যেমন অনুভূতি হয়েছিল, একই অনুভূতি আমার সন্তানদেরও হোক। আমি সে রকম একটি এক টুকরা ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় রইলাম।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্টিফেন স্ট্রমবার্গ: ওয়াশিংটন পোস্ট–এর কলাম লেখক