সংকুচিত বৈদেশিক শ্রমবাজার

গেল শতকের সত্তর দশকের শেষার্ধে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকে এই খাতের উত্তরোত্তর অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। এমনকি ইরাক যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আমাদের জনশক্তি রপ্তানি ২০১৭ সাল অবধি অটুট ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি আগের বছর থেকে ২৭ শতাংশ কমে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। অর্থনীতিবিদ ও জনশক্তি বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে আগেভাগে সতর্ক করে দিলেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন প্রমাণ নেই।

জনশক্তি রপ্তানি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার যেমন স্ফীত করেছে, তেমনি অর্থনীতিতেও গতি এনেছে। বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকের সংখ্যা
৮০ লাখ হলেও প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজারের প্রধান তিন দেশেই এখন ভাটার টান। সৌদি আরবে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ, ফলে সেখানেও দু–একটি নির্দিষ্ট খাত ছাড়া শ্রমিক নেওয়ার সম্ভাবনা কমে এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমবাজার খুলে দিলেও তারা গৃহকর্মী ছাড়া কোনো শ্রমিক নিচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক আমদানি বন্ধ আছে।

এ অবস্থায় সরকারের প্রথম করণীয় ছিল বিকল্প শ্রমবাজারের অনুসন্ধান ও দক্ষ শ্রমিক তৈরি। ইরাকের পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকায় সেখানে নতুন করে শ্রমিক নেওয়া শুরু হয়েছে। জর্ডানে তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে। ইতিমধ্যে যেসব শ্রমিক সেখানে গিয়েছেন, তাঁরা ভালো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এর বাইরে জাপান, থাইল্যান্ড ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। তবে পুরোনো কিংবা নতুন শ্রমবাজার—যেখানেই হোক, আগের মতো অদক্ষ শ্রমিকেরা আর সুবিধা করতে পারবেন না।

আমরা যদি বিদেশের শ্রমবাজার ধরে রাখতে চাই, বিদেশের চাহিদামাফিক শ্রমিক রপ্তানির দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব বলেছেন, ৭০টি কেন্দ্রে বিদেশে যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব কেন্দ্রে স্বল্প মেয়াদে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদামাফিক জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে, তা–ও ভেবে দেখতে হবে। বিদেশে আমাদের একজন কর্মী বছরে যে আয় করেন, এখানে কর্মরত একজন বিদেশি কর্মী তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি আয় করেন।

যেখানে বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি জনশক্তির চাহিদা কেন বেড়ে চলেছে তা গভীরভাবে সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। এটা পরিষ্কার যে আমাদের শিক্ষা দেশে চাহিদা আছে, এমন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে শিক্ষা দেশের চাহিদা মেটাতে পারে না, সেই শিক্ষা কীভাবে বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাবে? বিশ্বায়নের যুগে দরজা বন্ধ করে রাখা যাবে না। ফলে এমন জনশক্তি তৈরি করতে হবে, যাঁরা দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে বিদেশিদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেন।

আমরা যদি আমাদের জনশক্তিকে বিশেষায়িত শিক্ষায় দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও প্রবাসী আয় কমবে না। এই মুহূর্তে দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং নতুন বাজার সৃষ্টির কাজটি একযোগে করতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে বিমানভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকেরা আরও বেশি সংকটে পড়েছেন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এর যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করি।