অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়া কেন নয়

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্কের মানুষ এক অভিনব অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অভিনব বলছি বটে, কিন্তু কয়েক বছর ধরেই নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরেই এই বাজেট প্রক্রিয়া কাজ করছে। কমপক্ষে ১১ বছর বয়স এমন যে কেউ এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। এর লক্ষ্য, যার যার নিজের এলাকায় সবচেয়ে জরুরি এমন কিছু প্রকল্প নির্বাচন এবং তার জন্য ভোট প্রদান। সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে যে প্রকল্পগুলো, তার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে।

একদম নতুন নয় ধারণাটি। ব্রাজিলে ১৯৮৯ সালে থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট প্রস্তুতের চল রয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রায় তিন হাজার শহরে কোনো না কোনো রকম স্থানীয় বাজেট প্রস্তুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এ রকম একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিদেশি দাতাদের উৎসাহে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। সে কথায় পরে আসছি।

অংশগ্রহণমূলক বাজেট ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য, দেশের মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। গণতান্ত্রিক দেশে সব সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকে সরকার অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, যদিও পর্দার অন্তরাল থেকে কলকাঠি নাড়ান আমলারাই। দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার নামে বাজেট–সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে, কিন্তু রাজনীতিক বা আমলা কেউই যে সব সময় দেশের মানুষ কী চায়, সে কথা মাথায় রেখে সেসব সিদ্ধান্ত নেন, তা নয়। রাজনীতি তো রয়েছেই, তার ওপর রয়েছে যাঁর যাঁর নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অগ্রাধিকার। আমেরিকায় রাজনীতিকেরা, অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজ নির্বাচনী এলাকার বড় চাঁদাদাতাদের খুশি করতে অনেক সময় এমন সব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন, যাতে হাতে গোনা কয়েকজন দাতার লাভ হয়, সবার নয়। আলাস্কাতে
দুই কংগ্রেস সদস্যের জোরাজুরিতে একটি সেতু বানানো শুরু হয়েছিল, যা পরে রাজনৈতিক প্রতিবাদের কারণে বাদ দিতে হয়। সেই অসমাপ্ত সেতুর নাম ‘ব্রিজ টু নো হোয়্যার’।

অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষ কীভাবে অংশ নেয়, এবার এই নিউইয়র্কে তা দেখার সুযোগ হলো। এই বাজেটের জন্য যে থোক অর্থ আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখা হয়, তা আসে বিভিন্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নিজস্ব খাত থেকে। ‘ডিসক্রিশনারি’ বা ব্যক্তিগত বিবেচনাধীন হিসেবে পরিচিত এই খাতের অর্থ ব্যয়ের পুরো এখতিয়ার যাঁর নামে বরাদ্দ হয়েছে, সেই জনপ্রতিনিধির। এই থোক বরাদ্দের একটা অংশ কীভাবে ব্যয় হবে, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার তিনি ছেড়ে দেন নিজ এলাকার ভোটারদের ওপর। একইভাবে নিউইয়র্কের নগর সরকারের বাজেটের একটা অংশও অংশগ্রহণমূলক বাজেটের জন্য আলাদা করে রাখা হয়। খুব মোটা অঙ্কের টাকা নয়, নিউইয়র্কে যেমন চলতি বাজেটে এই প্রক্রিয়ার জন্য মোট ৩৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে বৈঠক হয়, এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার কায়দায় জায়গায় জায়গায় গিয়ে ক্যাম্পেইন করা হয়। যে প্রকল্পের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে, তার জন্যই অর্থ বরাদ্দ হয়।

পুরো বিষয়টির ব্যবস্থাপনার জন্য নগর প্রশাসন একটি আলাদা বিভাগ সৃষ্টি করেছে, যারা এই প্রক্রিয়ায় নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির নানা চেষ্টা করে থাকে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ল্যাবরেটরি, সে জন্য বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যাতে কিশোর-যুবকেরা এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা বিষয়ে আস্থা অর্জন করতে পারে। সে জন্যই মাত্র ১১ বছর বয়স হলেই যে কেউ এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। কোনো কোনো শহরে, যেমন বোস্টনে পুরো ব্যাপারটাই তরুণদের নিয়ন্ত্রণে, এর নামও সেই জন্য ‘ইয়ুথ লিড দ্য চেঞ্জ’ বা তরুণেরাই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বিষয়টি ইতিমধ্যে এতটা জনপ্রিয় হয়েছে যে কোনো কোনো স্কুলের বাজেটেও ছাত্রছাত্রীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই শহরের যে এলাকায় আমার বাস, সেখানে একটি স্কুলেও এই নিয়ম হয়েছে গেল বছর থেকে। ছাত্রদের বলা হয়েছিল তাদের মোট দুই হাজার ডলার দেওয়া হবে, তারাই ঠিক করবে কীভাবে এই অর্থ খরচ হবে। সবচেয়ে বেশি যে প্রকল্পের জন্য ভোট পড়বে, সেই খাতেই অর্থ বরাদ্দ হবে। আগের বছর দেখেছি, এই নিয়ে সবার মধ্যে কী উৎসাহ। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শেষে তারা মোট তিনটি প্রকল্পকে চূড়ান্ত করল। প্রথম প্রকল্প ছিল স্কুলের ভেতরে একটি পরিবেশসম্মত সবজির বাগান। দ্বিতীয় প্রকল্প একটি নাচ ও শরীরচর্চার স্টুডিও এবং তৃতীয় প্রকল্প সুপেয় পানি সরবরাহের নতুন ব্যবস্থা। নির্ধারিত দিনে সব ছাত্রছাত্রীকে এক সভায় সেসব প্রকল্পের গুণাগুণ তারাই বুঝিয়ে বলল। শিক্ষকেরাও তার ভালো দিক, মন্দ দিক নিয়ে মতামত দিলেন। এরপর হলো ভোটাভুটি। তাতে গ্রিনহাউস প্রকল্পটিই জয়ী হলো।

পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ মনে হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় এই বাজেট প্রক্রিয়ায় নতুন পাঠাগার হচ্ছে, নতুন গণশৌচাগার হচ্ছে, এমনকি নিখরচায় ইন্টারনেট ব্যবহারের কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। বিতরণের অর্থের অঙ্কে বা ফলাফলের হিসাবে এই সব প্রকল্পের কোনোটাই হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সরকারি লাল দড়ি বা আইন পরিষদের পাথুরে দেয়ালের বাইরে নিয়ে আসতে এর চেয়ে ভালো পথ আছে বলে শুনিনি। অন্যান্য শহরের কথা জানি না, কিন্তু নিউইয়র্কে যে অংশগ্রহণমূলক বাজেট ব্যবস্থা চালু আছে, তাতে যে কেউই এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কে বৈধ, কে অবৈধ, সে হিসাব কেউ রাখে না।

ব্রাজিলের পোর্ত আলেগ্রে শহরে, যেখানে এই পরীক্ষামূলক বাজেট ব্যবস্থা প্রথম চালু হয়, পুরো ব্যাপারটার একটি রাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে। বামপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে গৃহীত এই ব্যবস্থার মোদ্দা লক্ষ্য অবশ্য ছিল সেই একই—সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের মতো ব্রাজিলেও দুর্নীতি আকাশচুম্বী। অর্থের গন্ধ যেখানে, সেখানেই দুর্নীতি। ফলে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ক্ষমতাবানেরা, তাতে লাভও হয় প্রধানত ক্ষমতাবানদের। এই সমীকরণ বদলানোর তাগিদ থেকেই অংশগ্রহণমূলক বাজেট চালু করা হয়। ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, গ্রাম বা শহরের মানুষ নিজেরাই যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাকে বাস্তবায়িত করতে তাদের আগ্রহ হয় প্রবল। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, গণতন্ত্রের ভিত্তিকে যদি গভীর করতে হয়, তাহলে নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর অংশগ্রহণমূলক বাজেট তাতে সহায়ক হতে পারে।

আমাদের দেশে কি এমন ব্যবস্থা সম্ভব? বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে ড. আতিউর রহমান ও তাঁর দুই বাংলাদেশি সহকর্মী সিরাজগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাজেট প্রস্তুতের একটি উদাহরণ দিয়েছেন। প্রধানত জাতিসংঘ ও দাতাদেশগুলোর উৎসাহে এই প্রকল্প। প্রতিবেদনটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এর পুরোটাই লোক দেখানো। আমাদের দেশে, তা জাতীয় পর্যায়ে হোক বা উপজেলা পর্যায়ে, টাকার গোছা রাজনীতিক ও আমলারা ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। আলাপ-আলোচনার নামে যেসব সভার ব্যবস্থা সেখানে করা হয়, তাতে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নিজের লোকেরাই ভিড় জমান। গবেষক তিনজন স্বীকার করেছেন, নাগরিক অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও এই প্রক্রিয়ায় নাগরিক অংশগ্রহণ ছিল কার্যত শূন্য।

তার মানে, এমন একটা উদ্যোগ যে গ্রহণ আদৌ সম্ভব নয়, তা নয়। একজন উৎসাহী মেয়র চাইলেই তাঁর উন্নয়ন বাজেটের একটা অংশ অংশগ্রহণমূলক বাজেটের জন্য আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেন। আমাদের প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির রয়েছে তাঁর ‘ডিসক্রিশনারি ফান্ড’। চাইলে তিনিও এই অর্থের একাংশ ছেড়ে দিতে পারেন স্থানীয় জনগণের হাতে, তারাই ঠিক করবে গ্রামে নতুন সেতু হবে না একটি শিশু পাঠাগার নির্মিত হবে।

গণতন্ত্র একটা বহুতল ভবনের মতো। একদম ভূমি থেকে তাকে নির্মাণ করলে তবেই তা পোক্ত হয়। অংশগ্রহণমূলক বাজেট অনায়াসেই হতে পারে সেই ভবনের ভিত, তার বনিয়াদ।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি