লেডি অব ইউরোপের জন্য শোকগাথা

আগুনে পুড়তে থাকা নটর ডেম গির্জা
আগুনে পুড়তে থাকা নটর ডেম গির্জা

বার্লিনে বসে এই লেখা যখন লিখছি, ঠিক সেই মুহূর্তে দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকা নটর ডেম দো প্যারিসের (আওয়ার লেডি অব প্যারিস) ছবির সামনে আমি সাষ্টাঙ্গপ্রণত শ্রদ্ধাও জানাচ্ছি। স্বর্গ-নরকে যাঁরা বিশ্বাস করেন এবং যাঁরা করেন না, উভয় পক্ষের কাছেই পুড়ে যাওয়া এই নটর ডেম গির্জা মানবসভ্যতার এক অমূল্য সম্পদ। এই গির্জা ইউরোপের সৌন্দর্যের প্রতীক, ঐশ্বরিক ক্ষমা ও আশার প্রতীক, মহত্ত্ব ও ভব্যতার প্রতীক। আপনার মতো, বিশ্বের আর সবার মতো আমার হৃদয়ও আজ ভেঙে গেছে।
এই ট্র্যাজেডি বহু স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনে পড়ছে এই গির্জাকে অমরত্ব দিয়ে ভিক্টর হুগো লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম।
একইভাবে মহান কবি লুই আরাগঁ এই ‘লেডি অব প্যারিস’-এর উদ্দেশে লিখেছিলেন:

‘আগুনও নয় তোমার মতো শক্তিশালী
তোমার মতো ঝলকানি নেই বজ্রপাতেও
বিপদগ্রস্ত আমার প্যারিস তোমার জোরে
এক নিমেষে সকল বাধা ভাঙতে পারে
এই প্যারিসে কে আছে আর?
কে আছে আর তোমার মতো হে সুন্দরী!’

নটর ডেম গির্জা পুড়ে যাওয়ার সময় অনেকের মনে পড়তে পারে শার্ল বোদলেয়ারের ‘সৌন্দর্য’ কবিতার প্রথম লাইন, ‘হে নশ্বর মরণশীল পৃথিবী, চেয়ে দেখো প্রস্তরপটে আঁকা স্বপ্নের মতো আমিই অমর এক অনাদি সুন্দর’। লাইনটি বোদলেয়ার নটর ডেমকে নিয়েই লিখেছিলেন, তা নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তাকে নিয়ে এমন স্তবক লেখা যেতেই পারত।
লিখিত শব্দের সীমার বাইরে বহু বহু স্মৃতি রেখে গেছে এই গির্জা। ফ্রান্সের কয়েক শতকের ইতিহাসের চাক্ষুষ সাক্ষী এই গির্জা। কত কিংবদন্তিকে সে নিজের চোখে দেখেছে! আপন মহিমা দিয়ে সে শতক শতক ধরে ফ্রান্সের মর্যাদা বাড়িয়ে এসেছে।
আমি যখন এই ক্যাথেড্রালকে পুড়তে দেখছিলাম, তখন আমার মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল ১৯৪৪ সালের প্যারিসের স্বাধীন হওয়ার পর এর সামনে জনতার উল্লাসের ছবি। ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানেরা যখন তাঁদের প্রাণপ্রিয় গির্জাটি পুড়ে যেতে দেখে অশ্রুপাত করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমিও কাঁদছিলাম। পোড়া নটর ডেমের ছবি দেখার পরও আমার মনে হচ্ছিল হুগো কিংবা আরাগেঁর কথাগুলো এখনো ঠিক আছে। এখনো অবিনশ্বর সৌন্দর্য নিয়ে নটর ডেম দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল ভিক্টর হুগোর লাইন, ‘সময় মহান স্থপতি, মানুষ নিছক রাজমিস্ত্রি’।
একজন প্যারিসবাসীর কাছে তাঁর চোখের সামনে নটর ডেম পুড়ে যাওয়া যে কত যন্ত্রণাদায়ক, তা শুধু সে-ই বুঝতে পারে। শুধু সে-ই বুঝতে পারে, এটি কোনো ইট–সুরকির মামুলি কাঠামো ছিল না। মানবতার আত্মার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শুধু কি প্যারিসবাসী? ইতালীয়, সুইডিশ, আইরিশ, স্প্যানিয়ার্ড, চায়নিজ, আলজেরীয়—সবাই আজ হতবাক। এই অগ্নিকাণ্ডের পর সবাই এখন একই হ্যাশট্যাগে বলছে ‘জো সুই প্যারিস’ (আমিই প্যারিস)।
নটর ডেমের এই অগ্নিস্নান আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে ঐতিহ্য ও ইতিহাস রক্ষায় আমরা এখনো কতটা অসহায়। শিল্প ও প্রত্নসভ্যতা সংরক্ষণে আমরা কতটা উদাসীন।
আমরা এখন বুঝতে পারছি বিভক্তির হাত থেকে ঐক্যকে বাঁচানোর জন্য ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বুঝতে পারছি আমরা সম্মিলিতভাবে যেসব মন্দির, প্রাসাদ গড়ে তুলি তা আসলে মানবসভ্যতার সৌন্দর্য আর ঐক্যেরই প্রতিনিধিত্ব করে। নটর ডেম আমাদের এই শিক্ষাই দিয়ে গেল।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ দুই বছর ধরে ইউরোপের ঐক্য পুনর্গঠনের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনি নটর ডেম পুনর্নির্মাণের জন্য সবার কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তাঁর সেই আহ্বানের সঙ্গে আমিও একাত্মতা ঘোষণা করছি। ভিক্টর হুগোর মতো আমিও মনে করি, মহাকালই মহান স্থপতি, আমরা সবাই মামুলি রাজমিস্ত্রি। সেই রাজমিস্ত্রির ভূমিকায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আবার নটর ডেমকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এত সহজেই ‘লেডি অব ইউরোপ’ শেষ হয়ে যাবে, সেটি হওয়ার নয়। সেটি হবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

বেরনার–অঁরি লেভি ইউরোপের ‘নিউ ফিলসফারস মুভমেন্ট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক