নগর সরকার প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি

ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফ আর টাওয়ারের সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষমতার মারাত্মক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আবার আলোচনায় চলে এসেছে। রাজউক, ওয়াসা, পিডিবি, ডেসা, ডেসকো, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার কাজের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব যৌক্তিকভাবে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের দুজন মেয়রের হাতে থাকার কথা থাকলেও সংকটের সময় তাঁদের ক্ষমতাহীনতার বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ে যাচ্ছিল। সমস্যার মূলে যে ইস্যুটি রয়েছে তা হলো, সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের ধারণা বিশ্বের প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এই কনসেপ্টটি একটি ‘নিষিদ্ধ বিষয়’ (ট্যাবু) হয়ে রয়েছে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি—যে দলই হোক, এ দেশের শাসক মহলে নির্বাচিত মেয়রদের নগর পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে দিতে এক অদ্ভুত অনীহা গেড়ে বসে রয়েছে। এমনকি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশের শহরগুলোর পৌরসভার যতটুকু ক্ষমতা এবং দায়িত্বের পরিধি ছিল পাকিস্তান আমলে এবং বিশেষত আইয়ুব খানের শাসনামলে, সেগুলোও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছরেও ওই ক্ষমতাগুলো আবার সিটি করপোরেশন এবং মিউনিসিপ্যালিটিগুলোতে ফেরত দেওয়ার আইনি পরিবর্তনের গরজ কোনো সরকারের আমলেই দেখা যায়নি।

উন্নত বিশ্বে যে সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার চালু রয়েছে, সেগুলো থেকে কিছুই শিখতে চাইছি না আমরা, কিন্তু কেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং কানাডার নগর সরকার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আমাদের দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে অবিলম্বে সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হোক। যেভাবে এগুলোকে পাকিস্তানি আমলের আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাহীন ও পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, তার কোনো যুক্তি নেই।

বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি সরবরাহ, নগরীর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি দায়িত্ব আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার আগে দেশের পৌরসভাগুলোর ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৫৮ সালে যখন আমি চট্টগ্রাম শহরে বসবাস শুরু করেছিলাম, তখনো শহরের বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা এবং পানি সরবরাহ মিউনিসিপ্যালটির দায়িত্বাধীন ছিল। শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণ, নালা-নর্দমা নির্মাণ ও পরিচ্ছন্নকরণ, খাল খনন ও সংরক্ষণ, বর্জ্য অপসারণ—এগুলোও মিউনিসিপ্যালটির দায়িত্ব ছিল। আবার, বহুদিন আগে থেকেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করত চট্টগ্রাম পৌরসভা।

৫০ দশকের শেষে ওয়াপদা, ওয়াসা, ঢাকার ডিআইটি, চট্টগ্রামের সিডিএ এবং খুলনার কেডিএর জন্ম হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওয়াপদা বিভক্ত হয়ে এখনকার পিডিবি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড হয়েছে। ডিআইটি বর্তমানে রাজউকে পরিণত হয়েছে। পিডিবি থেকে ডেসা, ডেসকো, ডিপিডিসি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি এবং ওজোপাডিকো জন্ম লাভ করেছে। সম্প্রসারণশীল কর্মকাণ্ডের জন্য মূল প্রতিষ্ঠান ভেঙে একাধিক প্রতিষ্ঠান গঠন অনেকের কাছে যৌক্তিক মনে হলেও এহেন প্রশাসনিক পরিবর্তনের মূলে ছিল আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর কুমতলব, আমলাতন্ত্রের জাল বিস্তার সম্পর্কীয় ‘পারকিনসন্স ল’ এর ক্ল্যাসিক নজির এহেন আমলাতান্ত্রিক জাল বৃদ্ধি। ষাটের দশকে আমাদের চোখের সামনে মিউনিসিপ্যালটির কাছ থেকে একটার পর একটা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশের কথা আমি উল্লেখ করেছি, সেখানে নগর সরকারের আওতাধীনেই রয়ে গেছে এসব দায়িত্ব এবং এটাই যৌক্তিক। নগর সরকারের অধীনে থাকলে এসব কাজের সমন্বয় বিধানের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যেত, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক ক্ষমতাকেন্দ্রের টানাপোড়েন থেকেও রেহাই মিলত। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন ঢাকার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁরা দুজনেই একবুক আশা নিয়ে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলেন সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার অনুরোধ নিয়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা সম্মত হননি। বরং, তিনি ঢাকা সিটির উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমন্বয় সাধনের জন্য তদানীন্তন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন, যেটা পুরোপুরি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। হয়তো এখনো ওই ধরনের কোনো সমন্বয় কমিটির অস্তিত্ব কাগজে-কলমে থাকতে পারে, কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী সমন্বয়ের দায়িত্ব না নিলে কখনোই তা কার্যকর হবে না।

আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে সিটি করপোরেশনগুলোর আওতাভুক্ত এলাকার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ এবং রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, খাল খনন ও দখলদার মুক্তকরণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগর সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা না করলে সিটি করপোরেশনগুলোর বর্তমান সংকুচিত ক্ষমতা ও পঙ্গুত্বের নিরসন হবে না। এমনকি রাজউক, সিডিএ ও কেডিএর মতো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলোকে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে দেওয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিটি করপোরেশনগুলোর ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে টানাপোড়েনের কোনো সুরাহা হবে না। আমার প্রস্তাব, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নগর সরকারের বাইরে থাকবে, সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বটি আইনগতভাবে প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করুক একনেকের মতো একটি কমিটির মাধ্যমে। এই কমিটি মাসে অন্তত একবার বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেবে। আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন মেয়র মহোদয়রা।

চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখছি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং সিডিএর রশি টানাটানি এই নগরীর উন্নয়নকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে। মেয়র মহিউদ্দিনের তিনটি মেয়াদের বেশির ভাগ সময় বিএনপি সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত প্রকল্পগুলোকে আটকে দেওয়াই রুটিনে পরিণত হয়েছিল। (বিএনপির নেতা মীর নাছিরের দম্ভোক্তি ‘যত দিন মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকবে, তত দিন কোনো প্রকল্প পাস হবে না’ স্মর্তব্য)। ফলে অনেক সৃজনশীল প্রকল্প প্রস্তাব ভেস্তে গেছে।

আবার, সাবেক মেয়র মন্‌জুর আলম আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর আমলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বর্তমান সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা পায়নি, বেশির ভাগ ডাইভার্ট হয়ে গেছে সিডিএতে। এ রকম একতরফা অর্থায়ন-সুবিধা পেয়ে সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যান বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন, যেগুলোর উপযোগিতা প্রকৌশলীদের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ।

জাতিসংঘের ইউএনসিএইচএস চট্টগ্রাম নগরীর জন্য ১৯৯৩ সালে যে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছিল, সেখানে এসব তুঘলকি প্রকল্পের কোনোটাই ছিল না। মাস্টারপ্ল্যান ও সত্যিকার ফিজিবিলিটি স্টাডির মাধ্যমে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। উন্নয়ন আমরা সবাই চাই, কিন্তু উন্নয়নের নামে চট্টগ্রামে খামখেয়ালি চলছে। বছর দু-এক আগে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) তাদের ‘দ্য স্ট্যাটাস অব সিটিজ’ সিরিজের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম নগরীর শাসনক্ষেত্রের যে নৈরাজ্যের চিত্র উদ্‌ঘাটন করেছিল, সেখানেও সিটি করপোরেশনের ক্ষমতাহীনতাই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।

সমস্যাগুলো হচ্ছে: ১. মেয়রদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ২. সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা ঢাকায় কেন্দ্রীকরণ, ৩. মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় বছর অবিশ্বাস্য রকমের কম অর্থ বরাদ্দ, ৪. নগরীর মাস্টারপ্ল্যানকে অবহেলা করে প্রায় সব প্রকল্প গ্রহণ, ৫. নগরীর গভর্ন্যান্স ও উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৮টি সংস্থা ও এজেন্সির মধ্যে সমন্বয়ের সার্বক্ষণিক সংকট, ৬. ড্রেনেজ সমস্যা সমাধানের নামে অপরিকল্পিত প্রকল্পে বিপুল অর্থ অপচয়, ৭. স্টর্ম-স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার অভাব, ৮. খাল-নালা দখল, ৯. কর্ণফুলী নদীদূষণ, ১০. যত্রতত্র অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, ১১. যত্রতত্র শপিং সেন্টার নির্মাণ, ১২. নগরীতে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র ও খেলার মাঠের স্বল্পতা এবং ১৩. চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএর বিবাদপ্রসূত পাল্টাপাল্টি কর্মকাণ্ড।

ঢাকার ক্ষেত্রেও সমস্যাগুলো একই ধরনের। আমার বিশ্বাস, এই দুটি শহরে নগর সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া এসব সমস্যার সুরাহা হবে না।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক