শ্রীলঙ্কায় হামলার রহস্যময় শক্তি কারা?

রোববার ৮টি হামলায় রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা। এসব হামলায় নিহত দুই শতাধিক। ছবি: রয়টার্স
রোববার ৮টি হামলায় রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা। এসব হামলায় নিহত দুই শতাধিক। ছবি: রয়টার্স

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার মাত্র ৩৫ দিনের মাথায় আবার প্রার্থনারত মানুষের রক্তে ভাসল বিশ্ব। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ‘ইস্টার সানডে’কে সামনে রেখে আটটি স্থানে হামলায় শ্রীলঙ্কায় দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন বিদেশি। ২০০৯ সালে ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শ্রীলঙ্কায় এত বড় রক্তপাত এই প্রথম।

তামিলবিরোধী দীর্ঘ যুদ্ধাবস্থার কারণে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা গোয়েন্দা কাঠামো অতীতের চেয়ে এখন বেশ কঠোর ও সুগঠিত। তার মাঝেও বহু দূরে দূরে এবং খোদ কলম্বোতে অনেকগুলো সমন্বিত হামলার ভয়াবহতা সাক্ষ্য দিচ্ছে; এই আক্রমণের পেছনে সুদক্ষ পরিকল্পনা ও বড় শক্তি কাজ করেছে।

শ্রীলঙ্কার খ্রিষ্টানরা দেশটিতে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো জনগোষ্ঠী নয়। জনসংখ্যায়ও তাদের হিস্যা সামান্য—মাত্র ৬-৭ শতাংশ। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, অত্যন্ত ছোট জনগোষ্ঠী হলেও ১৯৯৫ সালে গৃহযুদ্ধ চলাকালে অনুরূপ আরেক বোমা হামলায় দেশটিতে ১৪৭ জন খ্রিষ্টানকে হত্যা করা হয়েছিল।

খ্রিষ্টানদের মাঝে তামিল ও সিংহলি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। যদিও তামিলদের সংখ্যাই বেশি। মূলত তামিলপ্রধান উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে এবং কলম্বোতেই বেশি খ্রিষ্টান থাকে। হামলা হয়েছে কলম্বো ও পূর্বাঞ্চলের বাত্তিকালোয়াতে।

রোববার সকালে ঘটা একাধিক বোমা হালায় নিহত লোকজনের কয়েকজনের মৃতদেহ ঘটনাস্থালেই কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ছবি: এএফপি
রোববার সকালে ঘটা একাধিক বোমা হালায় নিহত লোকজনের কয়েকজনের মৃতদেহ ঘটনাস্থালেই কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ছবি: এএফপি

এই হামলার পেছনে হিন্দু তামিল ও বৌদ্ধ সিংহলিদের সংশ্লিষ্টতারও বড় কোনো ঐতিহাসিক কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তামিলদের সঙ্গে সিংহলিদের যে রাষ্ট্রনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে তাতে খ্রিষ্টানকেন্দ্রিক কোনো উপাদান নেই। আবার হিন্দু তামিল ও খ্রিষ্টান তামিলদের মাঝেও বড় ধরনের কোনো সংঘাত নেই। অতীতে মুসলমান তামিলদের সঙ্গে এলটিটিইর সম্পর্ক খারাপ থাকলেও এলটিটিইর মূল নেতৃত্ব কাঠামোতে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, খ্রিষ্টান নয়। সম্প্রতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কাজুড়ে যেসব আক্রমণ হয়েছে সেটাও হয়েছে মূলত বৌদ্ধ সিংহলি কিছু সংগঠন দ্বারা। খ্রিষ্টান সিংহলিদের তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। আবার, বৌদ্ধধর্মীয় কিছু সংগঠন চার্চগুলোতে মাঝেমধ্যে প্রার্থনাসভায় হামলা করে থাকে। তবে সেটা এ রকম কোনো ভয়াবহ হামলার ইঙ্গিত দেয় না।

সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে, এটা এমন কোনো তৃতীয় শক্তি করেছে, যা পুরোদস্তুর একটা সন্ত্রাসী হামলামাত্র। কেউ এখনো কোনো দায়িত্ব স্বীকারও করেনি। অধিকাংশ হামলাস্থলেই আত্মঘাতী আক্রমণ হয়েছে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলোতে জানা গেছে। যদিও এসব বিষয়ে মন্তব্য করার মতো বিস্তারিত তথ্য পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

তবে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার কিছু সূত্র হামলার পেছনে ‘ন্যাশনাল তৌহিদী জামাত’ (এনটিজে) নামে স্থানীয় একটি মুসলমানপ্রধান সংগঠনের দিকে ইঙ্গিত করলেও তারা বিষয়টি অস্বীকার করছে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছে। খুব রক্ষণশীল মতাদর্শের হলেও এটি খুবই ছোট একটি সংগঠন এবং অতীতে এইরূপ কোনো হামলার সঙ্গে বা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের সংঘাতের কোনো নজির নেই। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সেখানে খুবই ধোঁয়াশা।

শ্রীলঙ্কার পার্শ্ববর্তী তামিলনাড়ুতে একই নামে যে সংগঠনটি রয়েছে সেটি সেখানে বেশ প্রভাবশালী। কিন্তু সেখানে ওই সংগঠন রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে থাকে সামান্যই। মূলত সমাজসেবামূলক কাজই বেশি করে তারা। তবে বাবরি মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে এরা সোচ্চার ছিল। তামিলনাড়ুর এনটিজে এবং শ্রীলঙ্কার এনটিজের মাঝে সাংগঠনিক সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের একাংশ তামিলনাড়ুর এনটিজের বিরোধীও।

শ্রীলঙ্কার মুসলমান সমাজও এই ঘটনায় হতভম্ব—মূলত দেশটির পূর্বাঞ্চলে যাদের বাস। স্মরণাতীতকাল থেকে সামাজিকভাবে তারা কোণঠাসা থাকায় এ মুহূর্তে যেকোনো ঘৃণাবাচক প্রচারণা তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

জনসংখ্যার হিস্যায় তৃতীয় স্থানে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানরা খুবই দুর্বল জনগোষ্ঠী। তাদের সংগঠনগুলো এ মুহূর্তে প্রধানত ক্ষমতাসীন রনিল বিক্রমেসিংহকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তামিল সংগঠনগুলোও একই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর মাঝে মুসলমানবিরোধী কিছু মনোভাব রয়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে সম্প্রতি মুসলমানদের সঙ্গে আর কারও সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না।

এ রকম একটি অনুমান–অযোগ্য অবস্থায় এই হামলা শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে যে ব্যাপক অবিশ্বাসের জন্ম দেবে এবং ধর্মভিত্তিক সমীকরণ আরও জটিল করে তুলবে তা বলাই বাহুল্য।

সন্ত্রাসী হামলায় লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া গির্জার ছবিটি টুইট করেছেন মুশফিকুর রহিম।
সন্ত্রাসী হামলায় লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া গির্জার ছবিটি টুইট করেছেন মুশফিকুর রহিম।

অন্যদিকে, দেশটির রাজনীতি জাতীয়ভাবে এত বেশি দুই ধারায় বিভক্ত যে, এই হামলার পেছনে পরস্পরকে দায়ী করার বাইরে এসে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতীয়ভাবে একক কোনো অবস্থান নিতে পারবে বলে মনে হয় না। ফলে ঘটনার কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত হবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল অনিবার্যভাবেই এখন সরকারের বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল করার অভিযোগ তুলবে। উত্তেজনা সামাল দিতে ইতিমধ্যে দেশটির স্কুল-কলেজে দুদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

যেহেতু তৃতীয় কোনো শক্তি কর্তৃক এই হামলা হয়েছে এবং হামলাকারীরা অতি বড় আকারে গোপন সহায়তা পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে—তাই এই ঘটনার তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের শক্তিকে চিহ্নিত করা না গেলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ভবিষ্যতেও ব্যাপক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকবে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ক গবেষক