শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার বার্তা কী?

হামলার শিকার একটি গির্জায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি। ছবি: এএফপি
হামলার শিকার একটি গির্জায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি। ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কার একাধিক গির্জা ও হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। কেবল হতাহত মানুষের সংখ্যা বিবেচনায়ই নয়, বরং এর ব্যাপকতার বিচারেও এই হামলাকে গত এক দশকের এবং সম্ভবত গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা বলে মানতে হবে। একসঙ্গে ছয়টি হামলা চালানোর ঘটনায় স্পষ্ট যে এটি একটি একক গোষ্ঠীর হামলা এবং অত্যন্ত পরিকল্পিত। হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী এবং বিদেশি পর্যটকেরা। দিন হিসেবে এমন দিন বেছে নেওয়া হয়েছে, যার ব্যাপক ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। এমন সব হোটেলে হামলা হয়েছে, যাতে করে এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক। সিরিজ হামলার পর আরও দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। যার একটি হামলাকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে। পুলিশের ভাষ্য, এসব হামলার অন্তত একটি আত্মঘাতী হামলা। হামলার ধরন, লক্ষ্যবস্ত এবং পরিকল্পনার মাত্রা একটি ছোট গোষ্ঠীর কাজ বলে ইঙ্গিত দেয় না।

এই ধরনের একটি বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন বলেই অনুমান করা যায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দারা তা আঁচ করতে পারলেন না, যা তাঁদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ১১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান দেশের সর্বত্র পাঠানো একটি অভ্যন্তরীণ ‘গোয়েন্দা সতর্কবাণী’তে দেশের উল্লেখযোগ্য গির্জাগুলোয় আত্মঘাতী বোমা হামলার আশঙ্কা করেছিলেন। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী রানিল ভিক্রামাসিংহে বলেছেন, তাঁর সরকারের কাছে এই ধরনের হামলার আগাম তথ্য ছিল। কিন্তু সরকার এই বিষয়ে নিবারক (প্রিভেন্টিভ) কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তাঁর কাছে যে তথ্য ছিল, তাতে হামলাকারীরা স্থানীয় বলে বলা হয়েছিল। কেন নিবারক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

আক্রান্ত একটি গির্জার ছাদে এক সেনার সতর্ক অবস্থান। ছবি: এএফপি
আক্রান্ত একটি গির্জার ছাদে এক সেনার সতর্ক অবস্থান। ছবি: এএফপি

পুলিশপ্রধান যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন, তাতে এই আশঙ্কার তথ্যসূত্র হিসেবে ‘একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’র কথা বলা হয়েছিল। তাতে ‘ন্যাশনাল তৌহিদী জামাত’ (এনটিজে) নামে মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি স্থানীয় সংগঠন এই হামলার পরিকল্পনা করছে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে এত ব্যাপক হামলা চালানোর মতো শক্তি ও পরিকল্পনা করার মতো অবস্থা তাদের আছে বলে ইঙ্গিত নেই। এ ছাড়া হামলার পর হামলার নিন্দা জানিয়েছে এনটিজে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে সংগঠনটির তরফ থেকে বলা হয়েছে।


হামলায় এনটিজের যুক্ত থাকার ইঙ্গিত কীভাবে পাওয়া গিয়েছিল, কারা পেয়েছিলেন এবং এর সত্যতা কতটুকু, তা তদন্তের পর এসব বিষয় পরিষ্কার হওয়া যাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

কোনো গোষ্ঠী এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। তবে শ্রীলঙ্কান সরকার বলছে, তারা হামলাকারী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী এবং হামলার আগে পুলিশপ্রধান অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকেই হামলার জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু তাঁদের দুজনের সূত্র একই কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে এমনটা অনুমান করাই স্বাভাবিক। যেকোনো দেশে বড় রকমের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য স্থানীয় লোকজনের সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন হয়। কোথাও কোথাও এর ব্যতিক্রম থাকলেও কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একধরনের যোগযোগ অনস্বীকার্য।

অন্যদিকে, এত বড় সন্ত্রাসী হামলা দেশের বাইরের (আন্তর্জাতিক) যোগাযোগ ছাড়া সম্ভব কি না, সেটা অবশ্যই বিবেচ্য। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কারণে সহিংস হামলা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর একটা অবকাঠামো থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রায় এক দশক আগে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সামরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং সমাজের সর্বত্র যে নজরদারির ব্যবস্থা বহাল আছে, তার ফাঁক গলে এই হামলার প্রস্তুতি কেবল অভ্যন্তরীণভাবে কতটা সম্ভব, সেটাও বিবেচ্য। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, কেমন চিন্তাভাবনা থেকে স্থানীয় লোকজন এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়।

হামলার শিকার একটি গির্জায় সেনাসদস্যরা। ছবি: এএফপি
হামলার শিকার একটি গির্জায় সেনাসদস্যরা। ছবি: এএফপি

আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যে ইঙ্গিত দেয়, তাতে শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয়ভাবে বিভক্তি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টার বিষয় স্পষ্ট। ইতিমধ্যে দেশটিতে ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত ভারসাম্য যখন অত্যন্ত দুর্বল, সেখানে অস্থিশীলতা সৃষ্টি এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে চাইলে এই পথ বেছে নেওয়াই স্বাভাবিক।
এমন সব হোটেলে হামলা হয়েছে, যাতে বিদেশি পর্যটকেরা হতাহত হন এবং তা বিদেশিদের মনোযোগ কাড়ে। যেকোনো সন্ত্রাসী হামলা কেবল হত্যার উদ্দেশেই চালানো হয় না, হামলার লক্ষ্য থাকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। শ্রীলঙ্কার হামলাকারীরা তাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এসব হামলার পেছনে সাধারণত একটা বার্তা থাকে। শ্রীলঙ্কায় রোববারের হামলার পর এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত, তাতে সুস্পষ্ট কোনো বার্তা নেই। বার্তা না থাকাই কি এ ক্ষেত্রে বার্তা হয়ে উঠছে? কেননা, কোনো বার্তা না থাকার কারণে এই হামলার দায় যেকেউ কারও ওপরে চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। সেটাই এই সন্ত্রাসীরা চায় কি না, তা বিবেচনায় রাখা দরকার।

আশার কথা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যম এবং সরকারি ভাষ্যে এযাবৎ দায়িত্বশীলতা লক্ষ করা গেছে। তারা সহজেই কারও দিকে আঙুল তোলেনি। আশা করা যায়, তারা এই দায়িত্বশীলতা বজায় রাখতে পারবে। অন্যথায় তারা হামলাকারীদের উদ্দেশ্য সাধনের উপকরণ হতে পারে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা আগের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক। কিন্তু আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে বাস করি। ভুয়া নিউজের মহামারির সময় এটি। ফলে, মনে রাখতে হবে, এই হামলার বিষয়ে তথ্যাদি যাচাই–বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটি বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর