যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ও দলীয় রাজনীতি

কুমিল্লার সমবায় পদ্ধতির উদ্ভাবক আখতার হামিদ খান একবার সন্তোষে গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। মাওলানা তাঁর প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা বর্ণনা করে তাঁকে বলেন, কাজ শুরু করার জন্য আমি প্রফেসর মীর ফখরুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। ভাসানীর কথা শুনে আখতার হামিদ বলেন, ‘কমিটি দিয়ে কাজ হয় না, মানুষ দিয়ে কাজ হয়।’

আখতার হামিদ খান ছিলেন একজন অভিজ্ঞ, সুশিক্ষিত ও অতি দক্ষ ব্যুরোক্রাট এবং কর্মপ্রাণ মানুষ। পল্লি উন্নয়নে তাঁর মডেল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের পল্লি উন্নয়নে এই অবাঙালি মানুষটির অবদান অতুলনীয়। পাকিস্তানি হয়েও একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরতার তিনি নিন্দা করেছেন।

আখতার হামিদ খানের কথার যথার্থতার প্রমাণ আমি গত ৪৫ বছরে বহুবার অনেক ব্যাপারে দেখতে পেয়েছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেশি বেশি দেখছি। বর্তমান সময়ে কোনো একটা ব্যাপার ঘটলেই এবং কোনো জ্বলন্ত ইস্যু সামনে এলেই সরকার একটি কমিটি বা তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। জনগণকে বুঝ দেওয়া হয়, কমিটি করে দিয়েছি, চুপ থাকো, কাজ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্কুল-কলেজগুলোর সমস্যা নিয়ে কয়েক বছর আগে আমার কথা হতো বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। তিনি ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখানে হোক বা টিএসসিতে তাঁর কক্ষে হোক, তাঁর সঙ্গে কথা হলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম। ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, সেটা খুব আশার কথা, কিন্তু তাদের অসুবিধা ও বিপদ অনেক। বিষয়টি নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন।

অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজ বাংলার মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু মুক্তির অনাবিল আনন্দ তারা উপভোগ করতে পারছে না। তারা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় যাচ্ছে বটে, কিন্তু আনন্দের পরিবর্তে একধরনের আতঙ্কে তারা সংকুচিত ও সন্ত্রস্ত। কিছু দুই-পা-বিশিষ্ট ক্ষুধার্ত নেকড়ে তাদের তাড়া করছে। ওই সব নেকড়ের দুটি হাতে আঙুলে তীক্ষ্ণ নখ। ওই নখের থাবায় আজ বাংলার অসংখ্য মেয়েশিশু, কিশোরী ও যুবতী নারী ক্ষতবিক্ষত।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা ইতিহাসের জঘন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয়, যে মুহূর্তে মেয়েরা কিছুটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, আত্মশক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে, সেই সময় নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন হাজার বছরের সব ইতিহাসকে অতিক্রম করে গেছে।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের একটি করে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এর
নাম দেওয়া হয়েছে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’। ১৯ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।

নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্টের রিটের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং তার আওতাধীন অফিস ও দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এ আদেশ মোতাবেক প্রতিটি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সচেতনতা বৃদ্ধি, কমিটি গঠন ও আইন প্রয়োগের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিও নির্দেশনা ছিল উচ্চ আদালতের। এ ছাড়া যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে বিদ্যমান আইনে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিচার নিশ্চিত করার কথাও বলা আছে নির্দেশনাটিতে।’ [সমকাল, ২১ এপ্রিল]

গত ১০ বছরে হাইকোর্টের নির্দেশনা কেন পালিত হয়নি অথবা কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়নি, সেটা বিচার-বিশ্লেষণ না করে যে ফরমান জারি হয়েছে, সেটাও যে আগামী ১০ বছরে কোনো ফল দেবে, তা বিশ্বাস করা স্রেফ বোকামি।

গত দু-তিন বছরে আমি অনেকগুলো স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। অনেক শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা হতাশাজনক, ম্যানেজিং কমিটি অযোগ্য অপদার্থ। শিক্ষকদের শিক্ষাদানে মনোযোগের অভাব। অন্যদিকে প্রত্যন্ত পল্লির অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা চমৎকার। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইমেলা, খেলাধুলা, নাটক, সংগীতচর্চা প্রভৃতি হচ্ছে।

কিছুদিন আগে নওগাঁ জেলার আগ্রা-দ্বিগুণ ইউনিয়নে ‘মজিবর রহমান বৃত্তি’ প্রদান অনুষ্ঠানে গিয়ে অবাক হই। প্রয়াত মজিবর রহমান ছিলেন বহু বছর আগ্রা-দ্বিগুণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সমাজসেবী। ওই এলাকার তরুণ-তরুণীরা দলমত-নির্বিশেষে শিক্ষানুরাগী। আগ্রা-দ্বিগুণ উচ্চবিদ্যালয়, চকমৈরাম মডেল স্কুলসহ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের শৃঙ্খলা ও পাঠ্যবইবহির্ভূত কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য।

অন্যদিকে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা দেখে মন খারাপ হয়েছে। প্রাঙ্গণ অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটের অবস্থা শোচনীয়। দরোজায় ছিটকিনি নেই তো পায়খানা-প্রস্রাবখানায় পানি নেই। ছেলেরা এদিক-ওদিক ঝোপঝাড়ের আড়ালে যায় তো মেয়েদের সমস্যার শেষ নেই। ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে কিছু যে আছে, তা কেউ জানে না।

সোনাগাজীর নিহত নুসরাতের মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এখন শ্রীঘরে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা। শুধু ওই মাদ্রাসার কেন, প্রজাতন্ত্রের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে সরকারি দলের বাইরের কারও সদস্য হওয়া অকল্পনীয়। বেসরকারি মাধ্যমিকে ম্যানেজিং কমিটি এবং উচ্চমাধ্যমিকে গভর্নিং বডি আছে। কওমি মাদ্রাসার নিয়মকানুন কী, তা স্পষ্ট নয়। অনেক কামিল-ফাজিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড করে দেয়, কোনো কোনো মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করে দেয়। অনেক মাদ্রাসায় কর্তৃপক্ষের দলাদলি ও মামলা-মোকদ্দমায় সরকার হস্তক্ষেপ করে এবং গঠন করে দেয় অ্যাডহক কমিটি।

২৫-৩০ বছর যাবৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাননীয় সাংসদদের ভূমিকা একচ্ছত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি গঠনের নিয়ম সরকার করে দিয়েছে। অভিভাবকদের প্রতিনিধি ৪ জন, শিক্ষকদের প্রতিনিধি ৩ জন, তার ১ জন হবেন নারী, সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধি ১ জন, প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বা যিনি জমি দান করেছেন, তাঁর প্রতিনিধি ১ জন, এলাকার বিদ্যানুরাগী বা সমাজকর্মী ১ জন এবং প্রধান শিক্ষক পদাধিকারবলে সদস্য। এলাকার বিশিষ্ট বিদ্যানুরাগী যদি হার্ভার্ডের পিএইচডিও হন এবং উপজেলা বিরোধী দলের সংস্কৃতি সম্পাদকের চাচাতো শালীর স্বামী হন, তাঁর পক্ষে কোনো ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া, কবির ভাষায় বলতে গেলে, ‘সবার উপরে এমপি সত্য তাহার উপরে নাই’। তবে কিছুকাল আগে সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, কোনো এমপি সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন।

যে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদগুলো অকার্যকর, সেখানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ কী ভূমিকা রাখতে পারবে, তা সহজেই বোঝা যায়। শিক্ষা বা নারীর নিরাপত্তা কোনো দলীয় বিষয় নয়। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক