বৈশ্বিক সন্ত্রাসের থাবায় দ্বীপরাষ্ট্র

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে একাধিক গির্জা এবং হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়
শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে একাধিক গির্জা এবং হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে একাধিক গির্জা এবং হোটেলে আত্মঘাতী হামলায় প্রায় ৩০০ লোক নিহত ও কয়েক শ আহত হওয়ার ঘটনা জাতীয় অথবা ধর্মীয় বিয়োগান্ত ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু। আমার মতো শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত যেসব নাগরিক বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন, তাঁদের কাছে এ ঘটনা কতটা হৃদয়বিদারক, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমার মতো হয়তো কেউই শ্রীলঙ্কার মতো দেশে এ ধরনের সিরিজ হামলার কথা কল্পনাতেও আনতে পারেননি।
বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক বিভেদ ও সমস্যা সম্পর্কে একটা গড় ধারণা আছে। দেশটিতে তিন দশক ধরে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। এই সময়কালে জাতিগত সংঘাত হয়েছে, তামিল টাইগারদের সন্ত্রাসী সংগঠন শত শত আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে। ওই গৃহযুদ্ধের কারণে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আন্তর্জাতিক স্বার্থ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো তখন দেশটি থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। তবে ২০০৯ সালে তামিলবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত যেসব খবর ও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে করা হচ্ছে, তামিল কোনো সংগঠন নয়; বরং স্থানীয় ইসলামভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এই হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, হামলাকারীরা তাদের লক্ষ্যস্থল সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা রেখেছে এবং লক্ষ্যস্থলগুলোর সর্বোচ্চ প্রতীকী গুরুত্ব সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল ছিল।
রাজধানী কলম্বোর সেন্ট অ্যান্থনি হচ্ছে দেশটির জাতীয় সমাধিক্ষেত্র। উনিশ শতকে তৎকালীন ডাচ শাসকেরা স্থানীয় ক্যাথলিকদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। নিহত সেই ক্যাথলিকদের এখানে সমাহিত করা হয়েছিল। এখানে বিপুল দেশি–বিদেশি এবং খ্রিষ্টান ও অখ্রিষ্টান পর্যটক আসেন। দেশটিতে ভ্রমণ শুরু করার আগে এখানে পরিদর্শন করেন তাঁরা। পরিবার–পরিজন নিয়ে শ্রীলঙ্কায় আমার সর্বশেষ ভ্রমণের সময় দেখেছি, গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর
আমাদের চালক প্রথমে এই গির্জায় গাড়ি থামিয়েছিলেন
এবং ভ্রমণ যাতে নিরাপদ হয়, সে জন্য সেখানে প্রার্থনা
সেরে নিয়েছিলেন।
আক্রান্ত দ্বিতীয় গির্জাটি হলো আমার মায়ের জন্মস্থান নেগোম্বোতে অবস্থিত সেন্ট সিবাস্টিয়ান চার্চ। নেগোম্বো রাজধানী থেকে উত্তর দিকে অবস্থিত একটি মৎস্য বিপণনের শহর। ষোড়শ শতকে পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকাকালে এখানে ক্যাথলিকদের বসবাস শুরু হয়। এখানে বর্তমানে ক্যাথলিক সংস্কৃতি অত্যন্ত জোরদার থাকার কারণে শহরটির ডাকনাম হয়েছে ‘খুদে রোম’। প্রতিবছর সাধু সিবাস্টিয়ানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে গির্জাটির পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই গির্জায় রাত–দিন প্রার্থনা হয়। প্রতিদিনই ধর্ম আলোচনা হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে শোভাযাত্রাও হয়। গৃহযুদ্ধের আগে এবং পরে—সব সময়ই এ অবস্থা সেখানে বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে।
কয়েক বছর আগে আমি আমার এক জ্ঞাতি বোন এবং তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে সেখানে গিয়ে উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। এখানে গিয়ে আমি নানা ধর্মাবলম্বীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিদর্শন দেখেছিলাম। সেখানে আমি কোনো জাতিগত বিভেদের চিহ্ন দেখিনি। কিন্তু আগামী বছরের ফেস্ট অব সেন্ট সিবাস্টিয়ানে কি আমি সেই ছবি দেখতে পারব? সেটি অবশ্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই হামলার ঘটনা কী অশনিসংকেত দেয়, তার ওপর নির্ভর করছে।
সুদীর্ঘ কাল ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কায় কয়েক শতাব্দী ধরে নানা ধর্মের লোকের আগমন ঘটেছে। এ কারণে এখানে ধর্মীয় বৈচিত্র্য বহু আগে থেকেই ছিল। বলা হয়ে থাকে খ্রিষ্টের জন্মের অন্তত ১০০ বছর আগে থেকেই এখানকার জনপদের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের যোগ ছিল। এর কয়েক শতক পর এখানে হিন্দুধর্মের আগমন ঘটে। মধ্য যুগে আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারের হাত ধরে এখানে মুসলমানরা আসেন। অন্যদিকে ষোড়শ শতকের দিকে ইউরোপীয় উপনিবেশের পর এখানে খ্রিষ্টানদের বসবাস শুরু হয়।
এই নানা ধর্মের অনুসারীরা সব সময় যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিলেন, তা কিন্তু নয়। তবে ভারত মহাসাগরের এই ছোট দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ধর্মীয় বিভেদের কারণে যেসব সংঘাত হয়েছে, তা কখনোই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বহির্বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে এখানকার কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর যোগসাজশের খবর কখনোই সামনে আসেনি।
তবে সর্বশেষ এই হামলার তীব্রতা ও ধরন সেই ধারণায় আঘাত হেনেছে। খবর বেরিয়েছে, শ্রীলঙ্কা সরকার আগে থেকেই এমন কয়েকটি ইসলামপন্থী স্থানীয় গ্রুপকে নজরদারিতে রেখেছিল, যারা এসব হামলা চালিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যদি ইসলামপন্থীরাই এই হামলা চালিয়ে থাকে, তবে এই গ্রুপগুলো যে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের স্রোতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
টরন্টোতে বসে আমি হামলার খবর শোনার পরপরই উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রীলঙ্কায় থাকা আমার পরিচিতজনদের ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। যে দেশটিকে আমি এত ভালোবাসি, সেখানে এমন একটি জঘন্য হামলা হয়ে গেল, তা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমিও তাঁদের কাছে আমার সমবেদনার কথা বলছিলাম। কিন্তু শ্রীলঙ্কার মানুষ এই সমবেদনার কথাকে কীভাবে নিচ্ছে, আমি সেটাই ভাবছিলাম। শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ নতুন বিষয় হতে পারে, কিন্তু আত্মঘাতী হামলা নতুন কিছু নয়। প্রায় এক দশক আগেও সেখানে তামিল টাইগাররা কিছুদিন পরপর বিস্ফোরণ ঘটাত।
শ্রীলঙ্কার জন্য মায়া হচ্ছে। দেশটি যা হারাল তার জন্য নয় বরং দেশটি যা ‘অর্জন’ করল, তার জন্য মায়া হচ্ছে। সেই ‘অর্জিত জিনিসটি’ হলো বৈশ্বিক সংঘাতময় দেশগুলোর ক্লাবের ‘সদস্যপদ’। এটি শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন এবং বিশ্বের জন্য নতুন।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

র‍্যান্ডি বয়াগোডা লেখক ও টরন্টো ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক