ঋণখেলাপিদের আরও সুবিধা

‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ বলে যে বাংলা প্রবাদটি আছে, ব্যাংক খাতের নীতিনির্ধারকেরা যেন সেটি উল্টে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আইনে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে কেউ ব্যাংকের টাকা মেরে পার না পেয়ে যান। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের একের পর এক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভালো ঋণগ্রহীতারাও খেলাপি হতে উৎসাহিত হবেন।

গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতি সংরক্ষণের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ঋণখেলাপিদের নতুন
করে সুযোগ করে দিয়েছে, যা কার্যকর হবে আগামী জুন থেকে। এখন ব্যবসায়ীরা চাইলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও ছয় মাস টাকা না দিয়ে খেলাপিমুক্ত থাকতে পারবেন। এতে একজন ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধের জন্য আগের চেয়ে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় পাবেন।
এর আগে ২ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঋণখেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ শোধ করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন। তবে এ জন্য তাঁদের এককালীন ২ শতাংশ টাকা জমা দিতে হবে। তারও আগে তিনি ৭ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। পরে সমালোচনার মুখে সেটি ৯ শতাংশে উন্নীত করেন।

এত সব হক না–হক সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও ব্যাংক খাতের অবস্থা দিন দিন নাজুক হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে লক্ষ কোটি টাকার ওপরে। আমাদের দেশে অর্থনীতির যে আকার, তাতে এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ শঙ্কা তৈরি না করে পারে না। যেখানে সরকারের কর্তব্য ছিল খেলাপিদের প্রতি আরও কঠোর হওয়া, সেখানে তাঁদের ক্রমাগত ছাড় দেওয়া ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেতই বটে।

নির্বাচনের আগে ব্যাংকমালিকেরা টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকার সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলেন। সরকারি আমানত বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সীমাও ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে বাড়ানো এবং ব্যাংকের করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়।

এসব সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকমালিকেরা সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা কার্যকর করেননি।
গত বছর কোনো কোনো ব্যাংক সুদের হার কিছুটা কমালেও এখন আবার পুরোনো হারে ফিরে যেতে শুরু করেছে। এ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একদিকে ব্যাংকমালিকদের সুবিধা বাড়ানো, অন্যদিকে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ছাড় দেওয়ায় ব্যাংক খাত যে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার পক্ষে অর্থমন্ত্রী যতই সাফাই গান না কেন, খেলাপিদের সুমতি আসবে বলে মনে হয় না। এর আগেও খেলাপিদের নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা যখন কোনোভাবেই ব্যাংকের সঙ্গে পেরে ওঠেন না, তখন অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা ঠুকে আত্মরক্ষার
চেষ্টা করেন। ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের মধ্যে ভালো ঋণগ্রহীতা ও মন্দ ঋণগ্রহীতা হিসেবে শ্রেণিবিভাজন করতে চাইছেন, সেটিও যুক্তিসংগত নয়। যাঁরা ইতিমধ্যে ঋণ আটকে রেখে মন্দ ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের ভালো হওয়ার বা করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাংকও ব্যাংক খাতের দুরবস্থায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে। ব্যাংক খাতের এই নাজুক অবস্থা যে দেশের পুরো অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।