শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সংঘাত বাড়তে পারে

ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার মাটি প্রায় ১০ বছর বিরতির পর পুনরায় রক্তাক্ত হয়েছে। ২১ এপ্রিল বিশ্বের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম পবিত্র দিন ইস্টার সানডেতে কলম্বো, কলম্বোয় আশপাশে এবং পূর্বাঞ্চলীয় বাত্তিকালোয়া শহরের তিনটি গির্জা এবং তিনটি পাঁচ তারকা হোটেলে প্রায় একই সঙ্গে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ৫০০ জনের মতো আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

এ হামলার পর দীর্ঘ সময় কেউ কোনো দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি, যেমনটা অন্যান্য সময়ে দেখা গেছে। এ হামলা নিউজিল্যান্ডের মতো একক সন্ত্রাসী বা ‘লোন উলফ’ হামলাও নয়। এ হামলার ব্যাপকতা, ভয়াবহতা এবং এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতি একক ব্যক্তির নয়, বরং একাধিক ও সংগঠিত ব্যক্তিদের ছাড়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত ঘটনার প্রায় তিন দিন পর আইএসের তরফ থেকে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করা হয়েছে। যদিও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। শ্রীলঙ্কা সরকারের পক্ষ থেকে একবার বলা হয়েছে যে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা হয়েছে। আইএসের পক্ষ থেকে অবশ্য তেমন কিছু বলা হয়নি। আসলে এই হামলার ঘটনা এখনো বিভ্রান্তি আর ধোঁয়াশার মধ্যে রয়ে গেছে। ভারতের এনডি টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শুনলাম, ক্রাইস্টচার্চে হামলার আগেই এই হামলার পরিকল্পনা হয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িতরা সবাই যে শ্রীলঙ্কার নাগরিক, সেটাও তিনি বলেছেন।

হামলার দিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শ্রীলঙ্কার পুলিশ কলম্বোয় এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। জানা গেছে, গ্রেপ্তারের সময় এক সদস্য আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটালে তিন পুলিশ সদস্যও নিহত হন। অবশ্য যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের কোনো পরিচয় পুলিশ প্রকাশ করেনি। পরবর্তী সময়ে সন্দেহভাজন নর-নারী গ্রেপ্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। হামলার এক দিন পর পুলিশের মুখপাত্রের সূত্রে আমরা জেনেছি যে সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা এই হামলার সঙ্গে জড়িত এবং সবাই শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা। পরে জানা যায় যে তাঁরা সবাই স্বল্প পরিচিত এবং স্থানীয় কথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতের (এনটিজে) সদস্য এবং এই সংগঠনের কথিত প্রধান মোহাম্মদ জাহারাম হাশিম এই ঘটনার হোতা। যে বাহনে করে বিস্ফোরক স্থানান্তর করা হয়েছে, সেই বাহন ও চালককে আটক করার খবর প্রকাশিত হলেও বেশি কিছু জানা যায়নি। এ পর্যন্ত যেসব ভাষ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে অনুমান করা ছাড়া চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।

হামলার ঘটনার পরদিন শ্রীলঙ্কার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজথা সেনারত্নে প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেছেন যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এ ধরনের হামলার যে খবর পুলিশ পেয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে জানানো হয়নি। একই সঙ্গে সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভা অন্ধকারে ছিল। দেশের স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রেসিডেন্টের অধীনে, কিন্তু পুলিশের নিরাপত্তা বিভাগের ডিআইজি রত্নায়েক চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি পুলিশের অন্য পরিচালকদের জানালেও এর অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টকে দেননি।

এই ব্রিফিংয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতির গুরুতর বিভাজনের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এটা অনেকেরই মনে থাকার কথা যে গত বছরের অক্টোবরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে সংবিধানবহির্ভূত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তা নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে বিরোধসহ সেখানকার রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টিই পরিষ্কার হয়েছে।

যা-ই হোক, উপমহাদেশের এই ভয়াবহ হামলার পেছনে কারা দায়ী, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। হামলার পরদিন সরকারের মুখপাত্র স্থানীয় একটি মুসলিম সংগঠন ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতের সম্পৃক্ততার কথা বললেও সেই সংগঠনের তরফ থেকে দায় স্বীকার করা হয়নি। সরকার সন্দেহ করছে যে হামলাকারীদের সঙ্গে দেশের বাইরের কোনো কোনো সংগঠনের যুক্ততা থাকতে পারে।

শ্রীলঙ্কার এত বড় হামলা এমন একটি অপরিচিত ও কথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন এককভাবে সংগঠিত করতে পারে, এটা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। এ হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পাওয়া না গেলেও এমন একটি হামলা পরিকল্পনার জন্য দীর্ঘ সময়, বিপুল বিস্ফোরক জোগাড় করা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের বিষয় রয়েছে। এ ধরনের হামলা চালানোর জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মভিত্তিক এমন একটি শক্তিশালী সংগঠন শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১০ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে গড়ে ওঠাও অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।

এমন দাবিকে নাকচ করে শ্রীলঙ্কার পূর্ব প্রদেশের গভর্নর মোহাম্মদ লেবে আলিম হিজবুল্লাহ বলেছেন, এই সংগঠনের পক্ষে এত বড় হামলার পরিকল্পনা এবং কার্যকর করার ক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। দ্য লিডারস নামের অনলাইন পত্রিকায় এক যৌথ প্রবন্ধে কে প্রাগালথ এবং হেমা সুব্রামনিয়াম লিখেছেন, খ্রিষ্টানদের ওপর এত বড় হামলার ক্ষমতাই রাখে না এনটিজের মতো সংগঠন। এই সংগঠনের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় ২০১৪ সালে, যখন দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধমূর্তি ভাঙার অভিযোগ ওঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এনটিজের নাম প্রথমে উচ্চারিত হয় ভারতের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ, দিল্লির বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির বক্তব্যে। উল্লেখ্য, সমগ্র শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও মাত্র ২১ লাখ মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আরও উল্লেখ্য যে এনটিজে নামে তামিলনাড়ুতে বড় সংগঠনসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এদের শাখা রয়েছে। এই সংগঠন তামিল মুসলিমদের জন্য সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তারা এ হামলাকে নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের তরফ থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাসও দিয়েছে। ভারতের এনডিটিভি তাদের এই বক্তব্য প্রচার করেছে (২২ এপ্রিল ২০১৯)।

কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উত্থান হয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এদের সংঘর্ষও হয়েছে। গত বছরের ২৫ মার্চ কলম্বোর গির্জায় প্রার্থনাতে বাধা দিয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল। গত কয়েক বছরে জাতীয় ইভেনজেলিক্যাল খ্রিষ্টান অ্যালায়েন্সের হিসাব অনুযায়ী ৮৬টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা খ্রিষ্টানদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শুধু গত বছরই ২৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের সূত্রে জানা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কায় বেশির ভাগ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী তামিল খ্রিষ্টান।

গত বছরই মুসলমানবিরোধী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে সরকারকে স্বল্প সময়ের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছিল। কাজেই উগ্র বৌদ্ধধর্মীয় উত্থান শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। সরকার ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে এ ধরনের শক্তির উত্থান সহজতর হয়, যার অনেক প্রমাণ রয়েছে।

শ্রীলঙ্কার এ হামলায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রথমত, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি। এমনিতেই তামিল হিন্দুরা ৩০ বছরের গৃহযুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই হামলা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে দেশটি। চারটি পাঁচ তারকা হোটেলে আক্রমণের প্রভাব শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ওপর পড়বে। পর্যটনশিল্পকে অন্তত কয়েক বছর এই চাপ বইতে হবে।

যারাই এই হামলা ঘটিয়ে থাকুক, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এই ঘটনা আরও সংঘাতময় করে তুলবে। এই সংঘাত শ্রীলঙ্কাকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার ওপরে রয়েছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির বিষয়টি, যা ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ ও কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করতে পারে। বিশ্বে যে ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা থেকে কোনো দেশই নিরাপদ নয়। নিরাপদ করতে হলে দেশে অভ্যন্তরের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]