তামাকের বিষচক্রে বাংলাদেশ

বাণিজ্য উদারীকরণের যুগে যেকোনো প্রকারের শুল্ক বা অশুল্ক বাধা বেমানান। তবে বাছবিচারহীনভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ গ্রহণও কোনো অর্থনীতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। বিশেষ করে তামাকের মতো ক্ষতিকর খাতে বিনিয়োগ মৃত্যু ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে গোটা অর্থনীতিকেই রুগ্‌ণ করে ফেলতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুজাতিক তামাক ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগের সুযোগ পান। ১৯৯১-২০০০ সালের মধ্যে ট্রান্স ন্যাশনাল তামাক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ গ্রহণকারী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত সাতটি দেশে তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৯৬ শতাংশ (ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল টোব্যাকো কন্ট্রোল)। একই সময়ে তামাকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় ৫১ শতাংশ এবং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তামাক ব্যবহারজনিত অকালমৃত্যু ও অসুস্থতা। সম্প্রতি জাপান টোব্যাকোর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বাংলাদেশেও তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনীতির নিয়মে এই বিনিয়োগ তামাক খাতের সঙ্গে যুক্ত সব সংযোগ খাতকে (তামাকচাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি) সম্প্রসারিত করবে এবং গোটা অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আবর্তে আটকা পড়বে। ভারত জাপান টোব্যাকোর ১০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আইন করে তামাকের সব ধরনের বৈদেশিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন, আমরা কেন পারলাম না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রীই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র, যিনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ২০৪০ সালের আগেই দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর সরকারের উদ্যোগেই ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং এফসিটিসিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, বর্তমান দেশে মোট তামাক ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লোখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর (১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব) ৩৫.৩ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার অনেক বেশি। প্রায় ৪৮ শতাংশ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করে, যা খুবই উদ্বেগজনক। তবে অতি উচ্চবিত্তের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ২৪.৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের (২৯.৯%) তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর (৩৭.১%) মধ্যে তামাক ব্যবহারের উচ্চ হার এবং নারীদের (২৪.৮%) মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের উচ্চ প্রবণতা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। দরিদ্র মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অসুস্থতাজনিত কর্মহীনতা এবং অকালমৃত্যু অনেক সময় গোটা পরিবারকেই দারিদ্র্যসীমার তলানিতে নিক্ষেপ করে। গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ী, একজন ধূমপায়ীর সিগারেট বাবদ মাসিক গড় ব্যয় হয় ১০৭৭.৭০ টাকা। অথচ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, একটি পরিবারে শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৮৩৫.৭০ ও ৭০০ টাকা। তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য তথা মানবদারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটত এবং একই সঙ্গে তা এসডিজি (লক্ষ্য-১ দারিদ্র্য নির্মূল) পূরণে অবদান রাখত। তামাক খাত থেকে সরকার প্রতিবছর যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে, তার তুলনায় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। তামাক খাত থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব এসেছে ২২,৮১০ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) হয়েছে ৩০,৫৬০ কোটি টাকা। তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার অধিকাংশই অকালমৃত্যু। প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে এই তামাকের কারণে। সব মিলিয়ে তামাকের কারণে জাতি অনেক অপূরণীয় ক্ষতির ভার বহন করে চলেছে।

বাংলাদেশে ব্যাপক হারে তামাক ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের দাম অত্যন্ত কম বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার পরই বাংলাদেশে সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য এখানে আরও সস্তা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) কর্তৃক রিলেটিভ ইনকাম প্রাইস (আরআইপি) পদ্ধতির মাধ্যমে সিগারেটের স্তরভিত্তিক সহজলভ্যতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে একজন ধূমপায়ীর উচ্চ এবং মধ্যম স্তরে ১ হাজার শলাকা সিগারেট কিনতে মাথাপিছু জিডিপির যথাক্রমে ৬.৪৬ ও ৪.১৫ শতাংশ ব্যয় হলেও ২০১৭-১৮ সালে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ৫.০৯ এবং ৩.২৭ শতাংশ। নিম্নস্তরে এই হার প্রায় একই রয়েছে। গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ বেড়েছে। অর্থাৎ সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় সিগারেটের ব্যবহার কমছে না।

বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর-কাঠামো অত্যন্ত জটিল এবং তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। বর্তমান তামাক কর কাঠামো বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন সিগারেটে একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে তামাক পণ্য ক্রয়ের সুযোগ থাকায় একটি মূল্যস্তরে তামাক পণ্যের দাম বাড়লে অথবা ভোক্তার জীবনমানে কোনো পরিবর্তন ঘটলে সে তার সুবিধামতো স্তরে বা পণ্যে স্থানান্তর করতে পারে। আবার, বাজেটে করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের বার্ষিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে, ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য বিশেষ করে গুল ও জর্দার উৎপাদন ও বিপণন চলে অনেকটা অনিয়ন্ত্রিতভাবেই। বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ (যাদের অধিকাংশ দরিদ্র এবং নারী) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। বাস্তবতা হলো, মোট তামাক রাজস্বের মাত্র ০.২ শতাংশ (২০১৭-১৮ অর্থবছর) আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো তামাক কর নীতিমালা না থাকায় এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। ফলে, তামাক পণ্যে করারোপের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের চেয়ে রাজস্ব প্রাপ্তিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

সার্বিকভাবে বাংলাদেশে তামাক পণ্যে কর পদক্ষেপ শক্তিশালী না হওয়ায় তামাক পণ্যের প্রকৃত মূল্য কার্যকরভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তামাকের ব্যবহার হ্রাসে এই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটি তেমন একটা কাজ করছে না এবং তামাক খাত থেকে সরকারের রাজস্বও তেমন একটা বাড়ছে না। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশ তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপে মিশ্রপদ্ধতি গ্রহণ করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশেও সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট (স্পেসিফিক) আকারে আরোপ করা হলে তামাক পণ্যের দাম কার্যকরভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এর ব্যবহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। পরিকল্পিতভাবে তামাক পণ্যে করারোপের জন্য একটি সহজ ও কার্যকর তামাক করনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে মূলধারার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, সম্প্রতি এসডিজি ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশনায় যে ৩৯টি টার্গেট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে তামাক ব্যবহার হ্রাস এবং অসংক্রামক মৃত্যু কমিয়ে আনার ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তামাকের ব্যবহার হ্রাসে দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার তালিকায় তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে আইন করে তামাক খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।

এ বি এম জুবায়ের: নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা।
[email protected]