কী জানলাম আর কী শিখলাম?

এফ আর টাওয়ার। ফাইল ছবি
এফ আর টাওয়ার। ফাইল ছবি

আগুন লাগার পর গিয়েছিলাম এফ আর টাওয়ারের কাছে। বুঝতে চেয়েছিলাম কেন বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, কোথায় ভুল হয়ে যাচ্ছে আমাদের। ৩ এপ্রিল বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক এস এম নাজমুল ইমাম, আশিক মোহাম্মদ জোয়ারদার, আমাদের সহযোগী মুহাম্মদসহ অন্যদের নিয়ে ভবনটি পরিদর্শনে যাই। আমরা খুব কাছ থেকে কারিগরিক দৃষ্টিতে দুর্ঘটনা–পরবর্তী এফ আর টাওয়ার ভবনটি সরেজমিনে পর্যালোচনা করি।

আমরা হেঁটে হেঁটে ভবনের দ্বিতীয় বেসমেন্ট থেকে ছাদ পর্যন্ত মোট ২৪টি ফ্লোরের কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণ করি। পরবর্তী সময়ে আমাদের একজন চৌকস সহকর্মী আবু তাইয়েব মোহাম্মদ শাহজাহানের সহযোগিতায় কম্পিউটার মডেলের (ফায়ার ডায়নামিক সিমুলেশন) মাধ্যমে আগুনে উদ্ভূত পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। সম্ভবত বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো ভবনের অগ্নিকাণ্ড বিশ্লেষণে ফায়ার ডায়নামিক সিমুলেশনের সহযোগিতা নেওয়া হলো।

আমরা জনস্বার্থে পুরো ঘটনাটির একটি কারিগরিক বিন্যাস করি এবং আমি মনে করি, জনসাধারণের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোসহ যা জানতে পারলাম, তার কিছুটা হলেও ব্যক্ত করা প্রয়োজন। যেহেতু বিষয়টা কারিগরিক, সাধারণ জনগণের কাছে সহজবোধ্য করার জন্য উপস্থাপন করা হলো।

১. আগুন লাগার কারণ ও অগ্নিভার

আগুন সৃষ্টি হয় তিনটি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে: ক. দাহ্য পদার্থ, খ. অক্সিজেন ও গ. তাপ। একেই বলে অগ্নিত্রিভুজ (ফায়ার ট্রায়াঙ্গল)। এই তিনটির কোনো একটি যদি উপস্থিত না থাকে, আগুন লাগবে না। কোনো একটি জায়গায় প্রতি বর্গমিটারে দাহ্য পদার্থের পরিমাণ হচ্ছে ওই জায়গার অগ্নিভার বা ফায়ার লোড। এফ আর টাওয়ারের অষ্টম তলায় ছিল অনেক পরিমাণে দাহ্য পদার্থ, যেমন কাগজ, প্লাস্টিক, আসবাব, দাহ্য ফলস সিলিং, কার্পেট, পর্দা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে সেখানে বিরাজ করছিল উচ্চমাত্রার অগ্নিভার, আর সেই সঙ্গে আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিও। ঘটনার দিন কোনো এক উপায়ে তাপ সংযোজিত হয়ে অগ্নিত্রিভুজ সম্পন্ন হয়ে যায়।

২. ভবনে আগুনের বিস্তার ও খোলা সিঁড়ি

কোনো দাহ্য পদার্থ যখন আগুনে পোড়ে, তখন তা অনেক সময় সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায় না, যাকে বলে অসম্পূর্ণ দহন এবং এর ফলে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে। এই ধোঁয়া বাতাসের চাইতে হালকা হওয়ায় ওপরের দিকে ধাবিত হয়—প্রথমে ঘরের ছাদের দিকে ধাবিত হয়, পরে অনুভূমিকভাবে কোনো খোলা জায়গা, যেমন জানালা, খোলা সিঁড়ি বা কোনো ফাঁকের দিকে যেতে থাকে। এফ আর টাওয়ারের খোলা সিঁড়ি দিয়ে ওই ধোঁয়া ওপরের দিকে যায়, তাই ওই সিঁড়ি ব্যবহারকারীরাও আক্রান্ত হন। দাহ্য গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস এবং জলীয় বাষ্পমিশ্রিত এই ধোঁয়া ওপরের খোলা কক্ষগুলোতে পৌঁছে যায়, ঘাটতি তৈরি হয় অক্সিজেনের। তাই অগ্নিনিরাপদ ভবন ডিজাইনের আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে স্থাপত্য ডিজাইনের মাধ্যমে ধোঁয়া পরিবহনের বাধা সৃষ্টি করা বা বিস্তার সীমিত করা।

৩. অগ্নিনিরাপদ/জরুরি নির্গমন সিঁড়ি

অগ্নিনিরাপদ সিঁড়ি এমন একটি সিঁড়ি, যা কিনা বহুতল ভবনের যেকোনো এক বা একাধিক তলায় আগুন লাগলেও ভবনের সব ব্যবহারকারী নির্বিঘ্নে ব্যবহার করে ভবন থেকে বের হয়ে জীবন রক্ষা করতে পারবেন। এটা ইট বা কংক্রিটের দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ, সাধারণ নির্মাণসামগ্রী দিয়েই তৈরি একটি সিঁড়িঘর, তবে ঢোকার দরজা হতে হবে অগ্নিনিরোধক, অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা অগ্নিমাত্রার। এই দরজার পাল্লা, চৌকাঠ, হ্যান্ডেল বা প্যানিক বার, দরজার কবজা এবং দরজার স্বয়ংক্রিয় ডোর ক্লোজার একই অগ্নিমাত্রার হতে হবে। এই সিঁড়িঘরের ওপরে সংযোজিত বিদ্যুতায়িত ফ্যান দ্বারা উচ্চ চাপে বাতাস দেওয়া হয়, যাতে ওই দরজা খুলে সিঁড়িঘরে ঢোকার সময়ও আগুন বা ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে।

৪. বহুতল ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবস্থা

ভবনে প্রতিবন্ধীরা জরুরি অবস্থায় অগ্নিনিরাপদ সিঁড়ি দিয়ে অন্যের সাহায্যে একটি বিশেষ ধরনের চেয়ার ব্যবহার করে নেমে যেতে পারেন। এই বিশেষ চেয়ারকে বলা হয় ‘সিঁড়ি অবতরণ চেয়ার’।

৫. একাধিক মালিক বা ভাড়াটে এবং ভবন ব্যবস্থাপনা

যেহেতু ভবন ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি কারিগরিক, তাই সব উন্নত দেশে ভবনের সার্বিক দায়িত্বে থাকে ভবন ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো মালিকপক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দায়িত্বভার নিয়ে থাকে। তারা ঠিক করে কখন ফায়ার ড্রিল করতে হবে, কখন যন্ত্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, বিল্ডিং কোড মোতাবেক সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না বা পরিচালিত হচ্ছে কি না ইত্যাদি।

৬. কাচের দেয়াল যেন আরেক ঝুঁকি!

বহুতল ভবনে সাধারণত সেফটি লেমিনেটেড কাচ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা ভেঙে গেলেও খুলে পড়ে না এবং অতি ছোট ছোট টুকরোতে বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকায় প্রায় সব ভবনেই সাধারণ কাচ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যখন এসব কাচ সহজেই ভেঙে যায় আগুনের তাপে অথবা ভূকম্পনে, তখন কাচগুলো বড় বড় টুকরো হয়ে ওপর থেকে মাটির দিকে ধেয়ে আসে মাধ্যাকর্ষণ বলের আকর্ষণে এবং অত্যন্ত ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

৭. সুউচ্চ বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ

ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভবনকে হাইরাইজ বলা যায় না, মিডরাইজ বলা চলে। ৫০ থেকে ১০০ তলা বা তার অধিক তলায় আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের মই দিয়ে আগুন ফাইট করা যায় না। ভবনে নিয়োজিত স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র অগ্নিনির্বাপণের কাজে ব্যবহৃত হয় যেমন হিট সেন্সর, স্মোক সেন্সর, গ্যাস সেন্সর, ওয়াটার স্প্রিংলার, ফোম, স্বয়ংক্রিয় স্মোক ভেন্ট, ফায়ার স্ক্রিন, ওয়েট রাইজার ইত্যাদি। এসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে নিছক জমির মূল্য বা জমির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার স্বার্থে বহুতল ভবন নির্মাণ করা একেবারেই উচিত নয়।

৮. যাঁরা বেঁচে গেলেন ও পরবর্তী করণীয়

যাঁরা এই রকম এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের মানসিক আঘাত পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তাই তাঁদের দিকে নজর দেওয়া খুবই জরুরি। তাঁদের পরিবারবর্গ, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবকে এখন তাঁদের পাশে থাকা বা তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন। জনস্বার্থে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে।

৯. দুর্ঘটনাকবলিত স্থান এবং আহত লোকজনকে স্থানান্তর

এমন ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে স্থানান্তরের আগেই জায়গায় রেখে তাৎক্ষণিক ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করতে হয়। শুধু স্ট্রেচারে করেই ঘটনাস্থল থেকে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হাসপাতালে স্থানান্তর করা বাঞ্ছনীয়, সবাই মিলে হাত–পা ধরে চ্যাংদোলা করে নয়। তাই কাজটি করে থাকেন প্রশিক্ষিত প্যারামেডিকরা। এই রকম ঘটনা তাৎক্ষণিক মোকাবিলার জন্য আমাদের দেশে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি দক্ষ প্যারামেডিক টিম গঠন করা দরকার, তাদের থাকবে আইসিইউ সাপোর্টসহ সুসজ্জিত অ্যাম্বুলেন্স। তারাও ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি ছুটে আসবে ঘটনাস্থলে।

১০. দুর্ঘটনা মোকাবিলায় আন্তবাহিনী ব্যবস্থাপনা

কোনো ঘটনা মোকাবিলার জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় হচ্ছে সমন্বিত উদ্যোগ, গভীর পর্যালোচনা ও প্রায়োগিক মূল্যায়ন। কাজটি শুধু করতে পারেন একটি আন্তবিভাগীয় কুশলী দল বা ট্যাকটিক্যাল টিম, যারা সরাসরি অগ্নিনির্বাপণ করবে না বা উদ্ধারকাজ করবে না, অনেকটা দূরে অবস্থান করেই সম্পূর্ণ ঘটনার পর্যালোচনা করবে, তথ্য সংগ্রহ করবে, প্ল্যানিং করবে এবং দিকনির্দেশনা দেবে।


ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক