চাপের মুখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র

উত্তর–পূর্ব ভারতে শেষ দফার ভোট গ্রহণ । ছবি: প্রথম আলো
উত্তর–পূর্ব ভারতে শেষ দফার ভোট গ্রহণ । ছবি: প্রথম আলো

গত লোকসভা নির্বাচনে যখন শেষ ধাপের প্রচারণা শেষ হলো, তখন সাধারণ মানুষ বলা যায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে প্রার্থীদের প্রচারকাজ অনেকটা উপদ্রবের মতো হয়ে উঠেছিল। এর পরের পাঁচ বছরে যতগুলো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে প্রার্থীদের উদ্ধত ও বাজে আচরণ দেখে মানুষ বিরক্ত হয়েছে।

এ বছরের নির্বাচনে আমরা আগের চেয়ে খারাপ অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, দেশটির গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তরোত্তর অবনতির দিকে যাচ্ছে। এবার প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) শেষ পর্যন্ত কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। সব দলের শীর্ষ নেতারাই যদি মডেল কোড অব কনডাক্ট বা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তখন ইসির অসহায় হয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।

এই দেশে নির্বাচন কমিশন যতই বিধিবিধান জারি করুক না কেন, ভারতের রাজনীতিকেরা অনেক বেশি চালাক। তাঁদের পক্ষে পাশ কাটানো সম্ভব নয়, এমন কোনো আইন, কানুন, বিধিবিধান জারির সাধ্য কারও নেই। সম্প্রতি যোগী আদিত্যনাথ, মায়াবতী, মানেকা গান্ধী ও আজম খানকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা বিরত রাখার জন্য ইসি নির্দেশ দিয়েছিল।

তাঁদের উচিত ছিল, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে সেই নির্দেশ মেনে নেওয়া। কিন্তু তাঁরা এমন সব কায়দা বের করলেন যে প্রচারণায় না গিয়েও তাঁরা সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন। ইসি নির্দেশ জারি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মায়াবতী একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। সেখানে তিনি বললেন, বিজেপির অঙ্গুলিনির্দেশেই ইসি তাঁর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেখানে তিনি ইসিকে দলিতবিদ্বেষী প্রতিষ্ঠান আখ্যা দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে তুলাধুনা করেন।

একজন প্রার্থী যখন এই ধরনের অভিযোগ আনেন, তখন সে খবর ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও তা-ই ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘উদীয়মান তারকা’ মায়াবতী এটি খুব ভালো করেই জানেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তব্য ও ঘটনার বিষয়ের তুলনায় তির্যক ও বিতর্কিত মন্তব্যগুলোর দ্রুত মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ‘বেহেনজি’ এটি ভালো করে জানেন এবং সে কারণেই তিনি এই সংবাদ সম্মেলন করে ইসির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। এতে তাঁর বিবৃতি এবং ইসির নির্দেশনার খবর ভাইরাল হয়ে পড়ল।

তবে বাকি তিনজনের তুলনায় মায়াবতী অনেক ভালো আচরণ করেছেন বলা যায়। যোগী আদিত্যনাথ জানেন, তাঁর অনুসারীরা তাঁকে যোগ্য ও কর্মদক্ষ নেতা হিসেবে যতটা না পছন্দ করেন, তার চেয়ে বেশি পছন্দ করেন ধর্মীয় নেতা হিসেবে। ইসির ঘোষণা শুনে তিনি ভিন্ন কায়দার আশ্রয় নিলেন। তিনি লক্ষ্ণৌয়ে গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত হনুমান মন্দিরে গিয়ে ধ্যানে বসে পড়লেন। তখন দেখা গেল নির্বাচনী প্রচারণায় না যাওয়ার পরও তিনি টেলিভিশনের পর্দায় এবং মুঠোফোনের মনিটরে ফুটে উঠলেন। ধ্যানমগ্ন যোগীর ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘জয়সিয়া রাম’, এই ভক্তিগীতি বাজতে থাকল।

ইসির যা করণীয়, ইসি তা-ই করেছে। ইসি কাউকে প্রচারণায় নামতে নিষেধ করতে পারে, কিন্তু কাউকে পূজা-আর্চা বা প্রার্থনায় বাধা দিতে পারে না। যোগীর এই মন্দির দর্শনের ছবি নিশ্চিতভাবে ভাইরাল হওয়ার মতো জিনিস এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। এর পরের দিনই তিনি অযোধ্যা ও দেবীপতনের মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়েন।

রামপুরে আজম খানের ছেলে অভিযোগ করে বসেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে ইসি তাঁর বাবাকে প্রচারণা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছে। এটি পরিষ্কার হয়েছে, ইসির নিষেধাজ্ঞা এসব নেতাকে জনসংযোগ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি।

জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ বিষয় নয়। মনে করে দেখুন, ১৯৯৫ সালে শিবসেনার প্রধান বাল ঠাকরেকে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটানা বিষোদ্গার করা থেকে ইসি বিরত রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তিনি ভোট দিতেও পারবেন না বলে ইসি আদেশ দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে শুধু তাঁর জনপ্রিয়তাই বেড়েছে। পরবর্তী নির্বাচনের পর আমরা দেখেছি, তাঁর দলের সদস্যরা অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। যে দেশে জাতপাত, ধর্ম, ভাষা, সম্প্রদায় ও আঞ্চলিকতাবাদের ভিত্তিতে রাজনীতি চলে, সেখানে এমন অবস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক।

এখানকার নির্বাচনের দ্বিতীয় বিপর্যয়কর বিষয় হলো অর্থকড়ির শক্তি প্রদর্শন। আয়কর দপ্তরের সূত্রমতে, এই নির্বাচনে অবৈধভাবে ব্যবহৃত হতে যাওয়া ৬৯৫ কোটি রুপি উদ্ধার করা হয়েছে। সবাই জানে, এই নির্বাচন ঘিরে কালোটাকার খেলা চলে। জাতপাত ও ধর্মের নামে স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি গরিব ভোটারদের মধ্যে টাকা ছিটানো হয়। এটিই এখানকার নির্বাচনী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোটারদের বুঝতে হবে, এই সামান্য কয়টি টাকায় নিজেদের ভোট বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের অধিকারকে খাটো করছেন। নির্বাচনে এই পেশিশক্তি, অর্থশক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতির সস্তা ব্যবহার হিস্টিরিয়ার মতো ভারতকে উন্মত্ত করে ফেলছে।

বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকনোমিস্ট তাদের ২০১৮ সালের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে ভারতকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশের তালিকায় রেখেছে। এতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এতটাই মাথাচাড়া দিয়েছে যে গণতন্ত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ যদি এক জোট না হয়, তাহলে এই নির্বাচনের পর ভারতের গণতন্ত্রকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে।

হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী শেখর ভারতের সাংবাদিক ও কলাম লেখক