সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিন

কেউ তাকে বলে দ্বিসুত্রক আণবিক গঠন, আর আমরা তাকে বলি দ্বিসুত্রক সম্ভাবনা ও আশা। যে কয়েকটি আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগৎকে তোলপাড় করে দিয়েছে গত শতাব্দীতে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ডিএনএর গাঠনিক বিন্যাস আবিষ্কার। আজ ২৫ এপ্রিল বিশ্ব ডিএনএ দিবস। শুধু ডিএনএর তথ্যকে প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে প্রতিবছর কয়েক শ কোটি ডলার উপার্জন করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ডিএনএতে প্রাপ্ত তথ্য, খাদ্যের মান উন্নয়নে প্রয়োজন ডিএনএকে জানা, অণুজীব বা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন ডিএনএর তথ্য জানা।

প্রশ্ন আসতে পারে কেন ডিএনএ এত গুরুত্বপূর্ণ? কী আছে ডিএনএর মধ্যে? যেকোনো জীবকোষে সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখে ডিএনএ। জীবকোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত একটি বিশেষ ধরনের দ্বিসুত্রক যৌগ হলো ডিঅক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড তথা ডিএনএ। ডিএনএর অভ্যন্তরে থাকে জিন। একেকটি জিন কিংবা কয়েকটি জিন সামষ্টিকভাবে শরীরের একেকটি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। জিন সাধারণত প্রোটিন তৈরির কাজ করে আর প্রোটিনগুলোই মূলত বিভিন্ন শারীরিক কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনা দেয়। সবগুলো জিনের সামষ্টিক তথ্যকে একসঙ্গে বলা হয় জিনোম। যেকোনো জীবের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেকগুলো জিনের দ্বারা। আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞান, দর্শন এবং কলা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রকে সমানভাবে আলোড়িত করেছে ডিএনএ। জীবনের নানান ক্ষেত্রকে এমন বহুমুখী সমৃদ্ধি দেওয়ার ক্ষেত্রে এককভাবে এত বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি আর কোনো অণু। একের পর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার সংঘটিত হয়েছে ডিএনএকে ঘিরে। এর পরিবর্তন, পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে জীবনের বিভিন্ন তথ্য উদ্‌ঘাটনে বিজ্ঞানের চিরন্তন অভিযাত্রায় নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিকশিত বিষয় নিঃসন্দেহে জিন প্রকৌশল এবং আধুনিক জীবপ্রযুক্তি, যা বর্তমান বিশ্বে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি নামে অভিহিত।

ডিএনএ তথা জিনের বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে দেখা দেয় বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া, আলঝেইমার, এডিস, হিমোফিলিয়া তথা রক্ত জমাটবাঁধাসহ শতাধিক রোগ। এসব রোগের যথাযথ কারণ অনুসন্ধান, রোগনির্ণয়ের উপযুক্ত পদ্ধতি এবং প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণা। পৃথিবীতে কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর জীবন বাঁচাচ্ছে ইনসুলিনের মতো যৌগ। উন্নত জাতের ধান, বন্যায় লবণসহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবনের স্বপ্ন দেখা যাচ্ছে ডিএনএর তথা জিনের গঠনগত পরিবর্তনের প্রযুক্তি আবিষ্কারের কারণে।

উন্নত দেশগুলো উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে জীবপ্রযুক্তিকে। জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা পণ্য ও শিল্পজাত পণ্য থেকে আসা আয়সহ জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য থেকে আসা মোট রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।

২০০৫ সালে সরকারিভাবে ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি পলিসি প্রণয়নের পর ২০১২ সালে মাত্র সাত বছরের মাথায় মালয়েশিয়া জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক এই খাতে প্রায় ৫,৫০০০ লোকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। আর এ খাত থেকে আয় প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান মুদ্রা। এটি দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ২.২ শতাংশ।

প্রশ্ন আসতেই পারে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি সাফল্য ছাড়া খুব আশাব্যঞ্জক চিত্র আঁকা যাবে না। সময় একেবারে চলে না গেলেও খুব বেশি দিন অপেক্ষারও সুযোগ নেই। আমাদের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় বিকল্প সমাধান হতে পারে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে জীবকোষ থেকে জ্বালানির রসদ তৈরি। খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি ও স্বাদ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন এনজাইম নামের বিশেষ কোষ-নিঃসৃত পদার্থ তৈরি, বস্ত্রশিল্পে রাসায়নিক রং ব্যবহারের জটিলতা দূর করতে কিংবা চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানায় দূষণ প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন ক্ষুদ্র অণুজীবকে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহার করা।

পেটেন্ট তথা মেধাস্বত্বের আওতায় পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিভিন্ন দেশের অধিকারে চলে যাচ্ছে। শুধু ডিএনএর সিকোয়েন্স উন্মোচন করে কিংবা ডিএনএ বার কোডিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন জীবের গঠনগত প্রকৃতি দেখিয়েই অনেক দেশ এগুলো তাদের অধিকারভুক্ত করে ফেলছে। পাট, ইলিশ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের সাফল্যের পর আমাদের দেশেও এ রকম উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

এ ব্যাপারে সরকারের তরফে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। জীবপ্রযুক্তির শিক্ষার্থীদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। এই ক্ষেত্রটিতে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনার হাতছানি।


ড. আদনান মান্নান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক