বিষাক্ত বায়ুতে শিশু ও উদাসীনতার 'পাপ'

কবি সৈকত দের কবিতার বইয়ের নাম ‘উদাসীনতার পাপ’। এই ‘পাপ’ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি করছি শিশুদের বিরুদ্ধে। ঢাকার বায়ুতে বিষ, গাজীপুরের বায়ুও মরে যাচ্ছে সমানতালে। এ ব্যাপারেও উদ্যোগী হতে হয়েছে উচ্চ আদালতকে। রাজধানীতে ধুলাবালুর জন্য দূষণ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধকল্পে অন্তর্বর্তীকালীন তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঢাকার বায়ুদূষণ বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য বেঁধে দেওয়া খোলা জায়গার বায়ুর মানের সূচক, তথা আউটডোর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের সাধারণ মান থেকে অনেক গুণ বেশি। এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

নির্দেশনাগুলো হলো ঢাকার বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে অন্তত দুইবার পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আদালত পরিচালনা করতে হবে,
রাজধানীর যেসব জায়গায় উন্নয়ন এবং সংস্কারমূলক কাজ চলছে এবং যেসব জায়গা থেকে ধুলাবালু তৈরি হচ্ছে, সেসব জায়গাকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ঢেকে দিতে হবে,
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কাজ করতে হবে,
নির্মাণাধীন স্থানগুলোকে দিনে অন্তত দুইবার পানি ছিটিয়ে ধুলাবালুর প্রবণতা কমাতে হবে।

বায়ুদূষণের কারণে দেখা গেছে, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের প্রবণতা আমাদের শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকাতে প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে। তবে সব থেকে বেশি ভয় হয় শিশুদের জন্য। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর, তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের নিচে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বছরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা আছেন অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাতাসে সিসার উপাদান বেশি থাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কারণে শিশুরা সহজেই হৃদ্‌রোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ভুগে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে শহরগুলোর রাস্তাঘাটে শিশুরা মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করছে, এই দৃশ্য এখন একটি সাধারণ বিষয়।

শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, অথচ এই শিশুরাই বর্তমানে দুর্বিষহ বায়ুদূষণের কারণে সম্মুখীন হচ্ছে নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতায়, যা তাদের পরবর্তী সময়ে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। অথচ বাংলাদেশ শিশু নীতিমালা ২০১৩–তে সুস্পষ্টভাবে শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তাই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে এখন। কারণ, এই শিশুদের যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশে সঠিকভাবে জীবনযাপনের সুযোগ–সুবিধা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে তার প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে।

এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে স্কুল-কলেজগুলোতে—যেখানে শিশুরা দিনের প্রায় বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করে—সবুজ গাছের আধিক্য, খোলা জায়গার পরিমাণ এবং সবুজ পার্ক ও খেলার মাঠ পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কি না। সে ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের পরিবেশকে বায়ু ও শব্দদূষণের হাত থেকে রক্ষাকল্পে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে শিক্ষা ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এমনকি মূল রাস্তা থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার পরিকল্পনা করতে হবে। যেসব স্কুল-কলেজ বর্তমানে যানবাহন পরিপূর্ণ মূল রাস্তার পাশে অবস্থিত, সেখানে দেশীয় সবুজ গাছের সারি দিয়ে পর্যাপ্ত বিভাজন তৈরি করা যেতে পারে। শহরের নাগরিকদের জন্য কিছু সামাজিক বিধিনিষেধ করা যেতে পারে, যা উন্নত বিশ্বে প্রচলিত। যেমন তারা তাদের বসবাসের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত স্কুল-কলেজে তাদের শিশুদের প্রেরণ করবে। এতে যানজট ও বায়ুদূষণ, দুটোই কমবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ভালো ও খারাপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈষম্য দূর করতে হবে সব থেকে আগে। শহরের ময়লা–আবর্জনা সঠিক স্থানে ফেলার ক্ষেত্রে শহরবাসী এখনো নিজেদের সচেতন করে গড়ে তুলতে পারেনি, যা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তাই অন্ততপক্ষে আমাদের নিজেদের শিশুদের কথা চিন্তা করে হলেও শহরের ময়লা–আবর্জনা নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

শুধু সিটি করপোরেশনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, নিজেদেরকে সচেতন হয়ে এই সমস্যার প্রতিকারে মাঠে নামতে হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে বায়ুদূষণের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহ পরপর স্কুল-কলেজগুলোতে বায়ুদূষণের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। একই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বায়ুদূষণ রোধকল্পে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। এমনকি তারা নিজ নিজ বাসাতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কীভাবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এ ছাড়া শহরের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে অন্ততপক্ষে ছুটির দিনে যন্ত্রচালিত যানবাহন, যা ধোঁয়া উৎপন্ন করে, সেগুলোকে নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা যেতে পারে, যেমনটি প্যারিস শহরে প্রচলিত আছে।

এ ছাড়া শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাইসাইকেল লেন ও পায়ে হাঁটার রাস্তা তৈরির মাধ্যমে নগরবাসীকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ভারী যানবাহনের ব্যবহার কমাতে যা বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তা ছাড়া আমাদের দেশে ইলেকট্রিক এবং হাইড্রোজেন ব্যবহৃত যানবাহনের ব্যবহার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও বাড়ানো যেতে পারে। শহরের মৃতপ্রায় খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে শহরজুড়ে জলযানের ব্যবস্থা বায়ুদূষণের পরিমাণকে অনেকটাই কমিয়ে দেবে। সবশেষে এই দূষণ রোধকল্পে শহরভেদে আমাদের সুদূরপ্রসারী কিছু টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা হতে পারে আগামী ২৫ বছরের জন্য। এই পরিকল্পনাগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তার সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি। তবে এ কথা সত্য, অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এই সমস্যার সবটুকু সমাধান করতে পারব না, তবে একটি একটি করে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু সরকারের পক্ষেও এ সমস্যা সমাধান করা দুরূহ, যদি না আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হই।

সজল চৌধুরী: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]