'অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম' কি তবে নতুন শুরু?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রথমে ভিডিওটি দেখে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। একদল যুবক হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। রাজধানীর পান্থপথের স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রদর্শিত হচ্ছে মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ব্যবসাসফল ছবি ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’। এই ছবির টিকিট কিনতেই দর্শকদের এমন দৌড়।

কী অবাক কাণ্ড! যেখানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ সিনেমাহল দর্শকদের অনাগ্রহে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খোদ রাজধানীতে এমন দৃশ্য!

টিকিটের জন্য মারামারি, রাত জেগে টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা—এগুলো তো শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচের আগে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনে দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। সিনেমা দেখার জন্য হুড়োহুড়ি, তা–ও আবার ঢাকায়? অবিশ্বাস্য! অথচ দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা কয়েক দিন আগেই জানিয়েছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। সেখানে আজকের প্রথম আলোর বিনোদন পাতায় যখন শিরোনাম দেখি, ‘টিকিটের জন্য ভোররাত থেকে লাইন’—মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।

ফিরে যাই নব্বইয়ের দশকে, যখন মফস্বলে বেড়ে ওঠা আমরা, কিছু সিনেমাপ্রেমী দর্শক এমনি করে টিকিটের জন্য দাঁড়াতাম লাইনে। কত মারামারি, হুড়োহুড়ি করে যে একখানা টিকিট জোগাড় করতাম, সে গল্প এখন কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না।

‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’ সিনেমার টিকিট কাটার এমন লাইন দেখে মনে পড়ে যায় আরেকটি ঘটনার কথা। আট বছর আগে নয়াদিল্লি গিয়েছিলাম সাফ ফুটবল টুর্নামেন্ট কাভার করতে। দিল্লির পাহাড়গঞ্জে যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম, তার পাশেই ছিল একটা সিনেমা হল। তখন সবে মুক্তি পেয়েছে বিদ্যা বালান অভিনীত ‘ডার্টি পিকচার’।
ঢাকা থেকে টুর্নামেন্ট কাভার করতে যাওয়া আমরা কয়েকজন সাংবাদিক সিনেমাটি দেখতে গেলাম। রাত ৯টার প্রদর্শনী। কিন্তু একটু আগেভাগেই চলে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার প্রদর্শনী ভাঙতেই যে দৃশ্যটি দেখেছিলাম, তা আমাকে এক ঝটকায় নিয়ে গিয়েছিল শৈশবে। দেখি, সিনেমা হলের পার্কিং এরিয়ায় সারি বেঁধে রাখা শত শত মোটরসাইকেল। সিনেমা শেষ হতেই হল থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি যাচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী। কারও কারও কোলে কয়েক মাসের শিশুও রয়েছে। ওই সিনেমা হলে রাখা মোটরসাইকেলের মতোই যে আমরা বাইসাইকেল রাখতাম আমাদের এলাকার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে! মাত্র দুই টাকা পার্কিং টোকেন ছিল। সাইকেল চালিয়ে উপজেলা শহর থেকে জেলা শহরে যেতাম। এমনকি মফস্বলের থানা শহরেও দেখেছি পার্কিংয়ে শত শত সাইকেল। অথচ এখন সেই সিনেমা হলগুলো হয়তো বন্ধই হয়ে গেছে।

গত মাসে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চমৎকার একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘সারা বিশ্বের ছবি দেখতে চাই, সব কটা জানালা খুলে দাও’। কথাগুলো যেন সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মনের কথা। এই যে বাংলাদেশের দর্শকেরা হলমুখী হচ্ছেন না, এর দায়টা কার?
আবার এই দর্শকেরাই হলে গিয়ে টিকিটের জন্য রাত জেগে দাঁড়িয়ে থাকছেন। তাহলে এর মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে?
আমরা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখতে চাই। কিন্তু পছন্দের সিনেমা পাই না। আর পছন্দের সিনেমা পাই না বলেই দর্শক কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোর দর্শক হারানোর অনেক কারণের একটি এই, পছন্দের সিনেমা না পাওয়া। এই ঢাকা শহরেই সিনেমা দেখতে গিয়ে আমি টিকিট না পেয়ে চলে এসেছি—এমন ঘটনাও ঘটেছে। বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘আয়নাবাজি’ দেখতে গিয়ে টিকিট না পেয়ে পরের দিন সপরিবারে ছবিটি দেখেছিলাম শ্যামলী সিনেপ্লেক্সে। ‘দেবী’, ‘দহন’, ‘আয়নাবাজি’—এসব সিনেমা কিন্তু বেশির ভাগ দর্শক হলে গিয়েই দেখেছেন। অথচ অনেক বাণিজ্যিক ছবির প্রযোজক হলে সিনেমা মুক্তি দিতেই এখন রীতিমতো ভয় পান। আর সেই আতঙ্কেই মূলত হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন সিনেমা হলের মালিকেরা।

হলিউডের ছবি যদি বাংলাদেশের সিনেমা হলে প্রদর্শনীর সেন্সরপত্র পায়, তাহলে কেন ভারত, ইরান, তুরস্ক ও কোরিয়ার ধ্রুপদী সিনেমাগুলো বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া হবে না? হলে গিয়ে দেখি না বলে কি আমাদের সিনেমা দেখা থেমে আছে? অন্তর্জালের হাজারো সাইটে অবারিত দুয়ার সিনেমার। যাঁর যখন ইচ্ছা করছে অনলাইনে সরাসরি বা ডাউনলোড করে সিনেমা দেখছেন। তাহলে তো সিনেমা দেখা থেমে নেই। শুধু থেমে আছে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা।

সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ফাগুন হাওয়া’ বা ‘যদি একদিন’ সিনেমার কথাই ধরা যাক। এই মুহূর্তে আইফ্লিক্সে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সিনেমা দুটি। বায়োস্কোপে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ‘দেবী’। চাইলে যে কেউ এসব সিনেমা নিজের মুঠোফোন বা ল্যাপটপে দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্বের অন্য দেশের অনেক সিনেমা এভাবে অনলাইনে মুক্তি পাচ্ছে। আবার সেই দেশে হলে গিয়েও দর্শক সিনেমা দেখছেন। শুধু আমাদের দেশেই সেই অভ্যাসটা কমছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের এই দর্শকের হাত ধরে আবারও যদি হলের মালিকদের ব্যবসাটা জমে ওঠে ক্ষতি কী?
আর যদি সত্যি সত্যি সিনেমা দেখার ‘সব কটা জানালা এভাবে খুলে দেওয়া যায়’, তাহলে কে জানে হয়তো ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দেখার জন্য যেমন উপচে পড়ত দেশের প্রতিটি সিনেমা হল, তেমনই হয়তো আবারও উপচে পড়বে হলগুলো। তবে জানালা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তো আগে নিতে হবে।