সংকটে বিএনপি, সংকটে সংসদ

ইতিহাসের কঠিন সময় পার করতে থাকা বিএনপিকে আগামী কয়েকটি দিন আরও বেশি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে এই কঠিন অবস্থা শুধু বিএনপির জন্য নয়; দেশের রাজনীতির জন্যও। ৩০ ডিসেম্বরের পর রাজনীতির সংজ্ঞা অনেকটাই পাল্টে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সাংসদদের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শপথ নিতে হবে। অন্যথায় তাঁদের সদস্যপদ থাকবে না। ৩০ ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সহযোগী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে মাত্র আটজন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বিএনপির সঙ্গেই তাঁদের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দেশবাসী নির্বাচনে কঠিন বা সহজ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই দেখেননি। দেখেছেন অন্য রকম ভোট, অন্য রকম ফলাফল। নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিদেশের বহু গণমাধ্যম এই নির্বাচনকে প্রহসন বলেছে।

বিরোধী দলের আট সাংসদের মধ্যে গণফোরামের দুই সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে আগেই শপথ নিয়েছিলেন। আবার গতকাল গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিলে উপস্থিতও ছিলেন। বিএনপির সাংসদ জাহিদুর রহমান গত বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন। এর পেছনে সরকারের চাপ ছিল বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘গণদুশমন’ হিসেবে।

তবে জাহিদুর রহমানের বিষয়ে বিএনপি গতকাল পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আজ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। জাহিদুর তাঁর শপথের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, ১৯৯১ সাল থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে কখনো জিততে পারেননি। এই প্রথম নির্বাচিত হন। দল যখন বাইরে আন্দোলন করে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারছে না, সংসদে গিয়ে তিনি তাঁর মুক্তি চাইবেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যে মামলা তুলে নিতে বলবেন।

বিএনপির নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আছেন। তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেবেন, তা কেউ মনে করেন না। কিন্তু অপর চার সদস্য কী করবেন? তাঁরাও কি জাহিদুরের পথ ধরবেন? শপথ নিয়ে সংসদে গিয়ে মুক্তি চাইলেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন? জাহিদুরের শপথ নেওয়ার আগে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। মন্ত্রীরা বলছেন, সরকার তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাউকে প্যারোলে পাঠাতে পারে না। প্যারোলে মুক্তি নিতে হলে বন্দীকে আবেদন করতে হবে। কিন্তু কথা হলো আবেদন করলেই যে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। দুই ক্ষেত্রে বন্দী প্যারোলে মুক্তি পেয়ে থাকেন। কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের জন্য।

জিয়াউর রহমানের আমলে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি তখন দণ্ডিত আসামি ছিলেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তিনি দণ্ডিত ছিলেন না; বিচারাধীন মামলার আসামি ছিলেন। একই সময়ে বিএনপির তৎকালীন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন বিচারাধীন মামলার আসামি হিসেবে। আদালতে তাঁর সাজা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এখন খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী হবে?

বিএনপির নেতারা মনে করেন না খালেদা জিয়া সরকারের অনুকম্পা নিয়ে জেলের বাইরে আসবেন কিংবা সরকার তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেবে। আইনি লড়াই কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমেই জেলখানা থেকে মুক্ত করতে হবে।

তবে বিএনপির মধ্যে সাংসদদের শপথ নেওয়া নিয়েও মতভেদ আছে। এক পক্ষ মনে করছে, যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেননি, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে গেলে ‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচনকেই বৈধতা দেওয়া হবে। এটি করা ঠিক হবে না। অপর পক্ষের পাল্টা যুক্তি, যখন আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাচ্ছে না, তখন দাবি তুলে ধরতে সব ফোরামই ব্যবহার করা উচিত। নির্বাচনটি যে প্রহসনমূলক হয়েছে, সে কথাটি সংসদে গিয়ে বললে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ক্ষমতাসীন জোটেরও কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করেছেন। বিএনপির সমর্থক একজন বুদ্ধিজীবী আলাপকালে খেদের সঙ্গে জানান, যে নেতারা মুখে বড় বড় কথা বলছেন, তাঁরা তো কাজের কাজ কিছুই করছেন না। সংখ্যায় যত কমই হোক, বিএনপির সাংসদেরা সংসদে গিয়ে কিছু কথা তো বলতে পারবেন। প্রতিবাদের সব ফোরামই ব্যবহার করা উচিত।

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সরকারি মহলে দুই ধরনের চিন্তাভাবনা আছে বলে জানা গেছে। সব দিক বিবেচনা করে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিলে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। জেল থেকে বের হয়েও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারবেন না। ফলে প্যরোলে তাঁকে মুক্তি দিলে সরকারই লাভবান হবে। তবে অন্য পক্ষের মত হলো, বিএনপিকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। শেষ বিচারে হয়তো আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থীরাই জিতে যাবেন। কেননা, তারা মনে করেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলেও বিএনপির অন্তত চারজন সাংসদ শপথ নেবেন।

শেষ মুহূর্তে নাটকীয় কিছু ঘটে কি না, সেটি দেখার জন্য আমাদের অন্তত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তবে বিএনপির শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির সাংসদেরা সংসদে গেলেই সংসদকে বৈধতা দেওয়া হবে, সে রকম ভাবার কারণ নেই। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংসদকে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেওয়া সংসদ হিসেবে গালমন্দ করে। তদুপরি সেই সংসদ ছিল আক্ষরিক অর্থেই রাবার স্ট্যাম্প। মূল ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্রপতি তথা সামরিক একনায়কের হাতে। ১৯৭৯ সালের সংসদে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে পেয়েছিল ৩৯টি। দলের বাঘা বাঘা সব নেতা ধরাশায়ী হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক সাংসদই সেই সংসদে ঝড় তুলেছিলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যেখানে প্রাথমিক গণনায় আওয়ামী লীগ জয়ী হতে যাচ্ছিল, সেখানে এরশাদ তাদের দিয়েছিল মাত্র ৭৬টি আসন। আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন করে দক্ষিণ প্লাজায় মক পার্লামেন্ট সাজালেও পরে সংসদে যোগ দিয়ে সরকারি দলকে ‘বিধ্বস্ত’ করতে সক্ষম হয়েছিল। তৃতীয় সংসদ স্থায়ী হয়েছিল দুই বছরেরও কম।

তবে এখন সংকটটি শুধু বিএনপির হলে ক্ষমতাসীনেরা স্বস্তিবোধ করতে পারতেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সার্বিকভাবে রাজনীতি ও সংসদকেই সংকটে ফেলে দিয়েছে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতনের পর গঠিত সংসদ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, সেটি এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে যে প্রাণবন্ত আলোচনা হতো, তা এখন চিন্তাও করা যায় না। আইন পাসের বিষয়টি জটিল। বেশির ভাগ সাংসদই বিল না পড়ে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দেন। যখন অধিবেশনের কার্যক্রম সরাসরি বেতারে প্রচার করা শুরু হলো, তখন দেখেছি রাস্তায় গাড়ির পাশে মানুষ কীভাবে ভিড় জমাত। সপ্তম সংসদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুকরণে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করা হলেও বিরোধী দলের সাংসদ ও জনগণের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখনো সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব আছে। প্রশ্নের ধরন বদলেছে। সব প্রশ্নে সরকারের বন্দনা গীত হয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়েই সংসদে আলোচনা হয় না বললেই চলে। ফলে সরকারি দলের সাংসদেরাই তো সংসদ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সংসদ মাঝেমধ্যেই কোরাম সংকটে ভোগে।

দেশে সংসদীয় রাজনীতি চালু আছে, সংসদীয় কমিটি আছে, কিন্তু কেউ সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ভাবেন না। সাংসদদের শপথ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে বিএনপি সংকটে আছে ঠিক। কিন্তু তার চেয়েও বেশি সংকটে আছে আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থা।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]