ময়মনসিংহ গেটটি রক্ষা করুন

ময়মনসিংহ গেটের তিনটি স্তম্ভের মাঝখানের স্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি
ময়মনসিংহ গেটের তিনটি স্তম্ভের মাঝখানের স্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি

বাংলাদেশে সাবেক পূর্ববঙ্গের সুলতানি ও মোগল আমলের পুরাকীর্তির অধিকাংশই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অল্প কিছু যা আছে, তা-ও অবহেলা ও অযত্নে বিলুপ্তির পথে।

ঐতিহ্যসচেতন ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ভারতবর্ষে তাঁদের শাসনকালে প্রাচীনকালের নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেন। ঔপনিবেশিক সরকার বাংলা ও উপমহাদেশের পুরাকীর্তিগুলোর তালিকা তৈরি করে। সে রকম একটি তালিকার বই আমার দেখার সুযোগ হয়েছে ভারতের কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বইটির নাম আ লিস্ট অব দ্য অবজেক্টস অব অ্যান্টিকুয়ারিয়ান ইন্টারেস্ট ইন দ্য লোয়ার প্রভিন্সেস অব বেঙ্গল (১৮৭৯)। বাংলার ভাটি অঞ্চলের পুরাকীর্তির ধ্বংসের কারণ হিসেবে তাতে বলা হয়েছিল, জলবায়ু অথবা অবহেলা (সাফার্ড গ্রেটলি ফ্রম ক্লাইমেট অর নেগলেক্ট)।

ওই বইয়ে মোগল আমলের শায়েস্তা খাঁ, মীর জুমলা ও সুলতান মোহাম্মদ আজিমের সময়ের বহু পুরাকীর্তির পরিচিতি রয়েছে। মোহাম্মদ আজিমের নামানুসারেই আজিমপুর এলাকার নাম। ঢাকা ও তার আশপাশের পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে অসমাপ্ত লালবাগ কেল্লা (১৬৭৮), সুলতান আজিমের স্ত্রী পরী বেগমের সমাধি, বড় কাটরা (১৬৪৫), ধানমন্ডি ঈদগাহ (১৬৪০), ঢাকেশ্বরী মন্দির, হোসেনি দালান, নারায়ণগঞ্জ সড়কে পাগলা ব্রিজ (১৬৬০), মিরপুর শাহ আলীর দরগাহ, মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গ এবং মীর জুমলার সময় তৈরি তখনকার ঢাকার উপকণ্ঠে (বর্তমান তিন নেতার সমাধির কাছে) ‘ময়মনসিংহ গেট’ (অনেকে ‘ঢাকা গেট’ও বলেন) এবং টঙ্গী ব্রিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হলে তার প্রকল্প কর্মকর্তা ইতিহাসবিদ এইচ ই স্টেপলটনও পূর্ব বাংলার পুরাকীর্তির ওপর একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাতেও রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ময়মনসিংহ গেটের উল্লেখ আছে।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাতায়াতের জন্য মীর জুমলা তৈরি করেন ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক। তুরাগ নদের ওপর নির্মাণ করেন টঙ্গী ব্রিজ। সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭) সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেটি ধ্বংস করে। পরে ব্রিটিশ সরকার তার পাশে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ করে। ঢাকা নগরীর শেষ সীমা চিহ্নিত করে নির্মাণ করা হয় ‘ময়মনসিংহ গেট’। নানা রকম অত্যাচার সত্ত্বেও গেটটি এখনো অক্ষত রয়েছে।

ময়মনসিংহ গেট অবহেলায় গাছপালার আড়ালে ঢেকে আছে। সেটিকে দৃশ্যমান করতে অনেকবার আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছি। সর্বশেষ যখন ঢাকা মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন আমি ময়মনসিংহ গেট যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করি। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ময়মনসিংহ গেটের কোনো ক্ষতি হবে না।

ময়মনসিংহ গেটের তিনটি স্তম্ভ: সড়কের দুই পাশে দুটি এবং মাঝখানে একটি। বর্তমানে সেটি সড়কদ্বীপে। খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মধ্যের স্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সেটির ওপর দিয়ে মেট্রোরেল গেলে ক্ষতি না-ও হতে পারে। সেখানে কর্মরত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদেরও আমি আমার উদ্বেগ জানিয়েছি। যদিও জাতির পুরাকীর্তি রক্ষার দায়িত্ব তাঁদের নয়। ক্ষতি হলে তাদের কিছু যায় আসে না।

এই পুরোনো নিদর্শন ধ্বংস হলে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায় হারিয়ে যাবে। সে জন্য সরকারের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, ময়মনসিংহ গেটটি যেন মেট্রোরেল নির্মাণের ফলে ধ্বংস না হয়। সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক