নির্বাচন কমিশনের রূপকথা চ্যালেঞ্জের মুখে

সাত ধাপে ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফা ভোট গ্রহণ হচ্ছে আজ। শেষ ও সপ্তম ধাপ শেষ হবে আগামী ১৯ মে এবং ভোট গণনা হবে ২৩ মে।

হাতে গোনা কয়েকটি আসন ছাড়া অন্যান্য জায়গায় এ পর্যন্ত বেশ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে বলে বিবেচিত। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মতৎপরতা এবং নির্বাচন পরিচালনায়, বিশেষ করে ‘মডেল কোড অব কনডাক্ট’ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতে সুনীল অরোরার নেতৃত্বে ২৩তম ইসি ভারতের অতীতের যেকোনো ইসি থেকে অনেক দুর্বল। ভারতের বর্তমান ইসির কর্মকাণ্ড নিয়ে যেভাবে উন্মুক্ত নেতিবাচক বিতর্ক হচ্ছে, অতীতে কোনো ইসিকে নিয়ে তা হয়নি।

বর্তমান ইসির বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ উঠেছিল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় নিয়ে। তারপর থেকে বড় দলগুলো, বিশেষ করে বিজেপি এবং বিরোধী কংগ্রেসের শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে যে বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হয়, তা ইসিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। বিজেপির প্রধান অমিত শাহর অনেকটাই উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামরিক বাহিনীর তথা আধা সামরিক বাহিনীর নামে ভোট প্রার্থনা করা ইত্যাদির বিরোধীপক্ষ থেকে জবাব দেওয়া শুরু হলে এই বাগ্‌যুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে।

এরই মধ্যে বিজেপির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার সংখ্যালঘুবিষয়ক বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য এবং বিরোধীদের, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের দুই আঞ্চলিক দলের একজনের সংখ্যালঘু-তুষ্টিমূলক বক্তব্য দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। উত্তর প্রদেশের বিজেপি দলের সরকারপ্রধান যোগী আদিত্যনাথের মুসলমানবিরোধী উক্তি এবং একইভাবে কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর মুসলমানদের তাঁর পক্ষে ভোট না দেওয়ার পরিণতি নিয়ে বক্তব্য পরিবেশ আরও উত্তপ্ত করে তোলে। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও অভিযোগ ওঠে যে ইসি শুধু স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য গ্রহণ করা ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ইসির তথাকথিত নির্লিপ্ততা নিয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষজ্ঞ ও প্রতিপক্ষের মধ্যে অনাস্থার সৃষ্টি হতে থাকে, যা এর আগে ভারতীয় ইসির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

২৩তম নির্বাচন কমিশনের এই নির্লিপ্ততা অথবা ‘দেখি কী করা যায়’ মনোভাব নিয়ে অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক বোদ্ধারা। ইসিও এই প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করল যে ‘মডেল কোড অব কনডাক্ট’ প্রয়োগ করার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা নেই কমিশনের হাতে। কারণ, এই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এই আচরণবিধি রাজনৈতিক দল এবং ইসির সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ার বেশি কিছুই নয়।

১৯৬২ সালে কার্যকর এই আচরণবিধি বেশ কয়েক দফা হালনাগাদ হয়েছে। তবে ২০১১-১২ সালে এই আচরণবিধির কার্যক্ষমতা অথবা ফলপ্রসূতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে আচরণবিধিকে আইনি রূপ দেওয়ার প্রস্তাব তৎকালীন ইসির কাছে পাঠালে ইসি এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দেয়। তখন তারা বলেছিল, যেহেতু আদালতও এই আচরণবিধি লঙ্ঘনকে মামলাযোগ্য অপরাধ মনে করেন এবং বর্তমানে যথেষ্ট কার্যকর, সেহেতু আইনি রূপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। (এস ওয়াই কোরেশি, অ্যান আনডকুমেন্টেড ওয়ান্ডার, ২৪০ পৃ.)। আচরণবিধিকে আইনি রূপ না দেওয়ার ব্যাপারে ইসির সিদ্ধান্তের পেছনে যা কাজ করেছে, তা হলো আইনি রূপ দেওয়া হলে ইসির সিদ্ধান্ত আইনের আওতায় আসবে এবং সে ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ হতে পারত।

তবে বর্তমানে ইসির হাতে তেমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকলেও সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ কমিশনকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে এবং তার আওতায় ব্যবস্থা নিতে পারে। মডেল কোডের ওপর সাবেক সিইসি এস ওয়াই কোরেশি তাঁর রচিত উল্লিখিত বইয়ের ৩৪৫ পাতায় লিখেছেন, মডেল কোড লঙ্ঘন করলে দল বা প্রার্থীকে ভর্ৎসনা অথবা নোটিশ করা ছাড়া ইসির আর তেমন কিছুই করার নেই। তবে কোরেশির মতে, এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো যখন ব্যাপক প্রচার হয়, সেটাই একধরনের শাস্তি। কিন্তু এবারের প্রচারণার সময় আচরণবিধি লঙ্ঘনের দিকে ইসি প্রথম দিকে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি, এমনকি সতর্কও করেনি। এ কারণে ক্রমেই কোড অব কনডাক্ট ভাঙার হিড়িক পড়তে থাকে। এমনকি উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খান এককালের চিত্রনায়িকা ও বর্তমানে রাজনীতিবিদ জয়াপ্রদাকে নিয়ে যে ধরনের নোংরা বক্তব্য দিয়েছেন, তঁার বিরুদ্ধেও ইসি নীরব ছিল।

ভারতীয় ইসির এই নীরবতা ও অসহায়ত্ব ভারতের উচ্চ আদালতের নজর এড়ায়নি। ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট ইসির নীরবতা এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাম্প্রদায়িক ও মায়াবতীর সংখ্যালঘু তোষণের মতো কোড অব কনডাক্ট-বহির্ভূত আচরণের ক্ষেত্র ইসি কী ব্যবস্থা নেবে, তা জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ইসিকে ‘ঘুম থেকে জাগতে’ বলে এই মন্তব্য করেন যে ইসি যদি এক দিনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেয়, সে ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৫ এপ্রিল ২০১৯)। এর পরপরই ইসি এ বিষয়ে দারুণ তৎপর হয়ে ওঠে এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, বিএসপি নেতা মায়াবতী, এসপির নেতা আজম খান এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর নির্বাচনী প্রচারণার নির্দিষ্ট সময় নিষিদ্ধ করার মতো শাস্তি দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পর ইসি নড়েচড়ে বসলেও প্রধানমন্ত্রীর আচরণবিধি লঙ্ঘন করার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ইসিকে ভর্ৎসনার ঘটনাও যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি এই পর্যায়ের হাইপ্রোফাইল নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও বিরল।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা ঘটনা এবং এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার পর ইসি কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিলেও এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে। আয়কর বিভাগ তামিলনাড়ুতে শুধু বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের বাড়িতে কালোটাকার সন্ধানে অভিযান চালালেও সরকারি দলের লোকজনের বিরুদ্ধে তা হচ্ছে না। বিরোধী দলগুলো বলেছে, এ ধরনের একপেশে তল্লাশির বিরুদ্ধে ইসি নীরব কেন? নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার, তা উদ্ধারের পর ভেলোরের লোকসভা নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত করার একক ক্ষমতা ইসির হাতে না থাকায় ওই নির্বাচন স্থগিত করতে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিতে হয়েছিল। ইসিকে এ ধরনের ক্ষমতা প্রদানের জন্য আরপিএ ১৯৫২ ধারা ৫৮-র সঙ্গে ধারা ৫৮-এ যুক্ত করার সুপারিশ আইন কমিশনের মাধ্যমে উত্থাপন করলেও বিজেপি বা মোদি সরকার আমলে নেয়নি। ধারা ৫৮-তে শুধু নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ইসি এই ধারায় নির্বাচন বন্ধ করতে পারে। কালোটাকা উদ্ধার এ ধারার বাইরে। সুপারিশকৃত ৫৮-তে এ ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে যে ধরনের অভূতপূর্ব আচরণবিধির ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে, তাতে ভারতীয় ইসির যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল এবং আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোতে যে মর্যাদার আসন পেয়েছিল, সেখানে ছেদ পড়েছে। ভারতের ইতিহাসে এবারই প্রথম অতীতে কোনো না কোনো পর্যায়ে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন ৬০ জনের বেশি আমলা ইসির অপারগতা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেছেন। এমনকি শতাধিক সাবেক সামরিক কর্মকর্তা সরকারপ্রধান ও সরকারি দল কর্তৃক সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে আনার উদ্যোগের বিরুদ্ধাচরণ করে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি পাঠিয়েছেন। এসব চিঠির ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ধরনের চিঠিপত্র ইসির ওপর আস্থাহীনতা বাড়াবে।

কেন বর্তমানে ভারতীয় ইসির এমন অসহায়ত্ব, প্রকারান্তরে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে, তা হলো ভারতীয় ইসির নিয়োগপদ্ধতি। এ নিয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে সাবেক সিইসি কোরেশি দ্য হিন্দু পত্রিকায় এক বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, সংবিধানের ধারা ৩২৪-এর পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবে আইনের দ্বারা নিয়োগপদ্ধতি তৈরি করতে কলেজিয়াম তৈরির কথা, ল কমিশনের সুপারিশের পরও কোনো সরকারই তা আমলে নেয়নি। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ সরকারের ইচ্ছায় হয়ে থাকে, যে কারণে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। উল্লেখ্য, এই উপমহাদেশে শুধু বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলোয় আইন দ্বারা গঠিত স্থায়ী কলেজিয়ামের মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিয়োগ করা হয়। তেমন ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে হালে ভারতে ক্রমেই এ দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন। অতীতে এসব বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য আইনের খসড়া তৈরি করে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন উত্থাপন করলেও তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও এখন নেই।

বর্তমানের ভারতীয় ইসি নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন, ভারতের ৭২ বছরে নির্বাচনী ব্যবস্থার যে ধাপে ধাপে বিস্তৃতি হয়েছে, সে ব্যবস্থাপনায় ইসির পক্ষপাতিত্ব খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। বেশ বিতর্ক ও চাপের কারণে ভারতের বর্তমান ইসি সমালোচনাগুলো থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। এর অন্যতম কারণ, ভারতের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও কর্মতৎপরতা। অতীতেও বিচার বিভাগকে ইসির শক্তি ও শক্ত সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে। ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্ত অবস্থানের কারণেই ভোটারদের ইচ্ছাতেই সরকার বদল হয় এবং গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হলে তা সমগ্র অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]