রাজপথে ইউরোপ ও আফ্রিকা

গণতন্ত্রের দাবিতে ৩০ বছরের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সুদানের জনগণের বিক্ষোভ
গণতন্ত্রের দাবিতে ৩০ বছরের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সুদানের জনগণের বিক্ষোভ

১৫-১৬ বছরের এক কিশোরী ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে আলোড়ন তুলেছে। স্কুলের ক্লাস বর্জন করে প্রথমে সে একাই রাস্তায় বসেছে প্রতিবাদ জানাতে। এরপর তার সহপাঠীরা এবং আস্তে আস্তে দেশ ও দেশের বাইরেও ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। মন্ত্রী-সাংসদেরা তার কথা শুনছেন। সে জনসভায় বক্তৃতা করছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তার বক্তৃতার সময়ে সেই পার্লামেন্ট সদস্যরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানিয়েছেন।

এই কিশোরীর নাম গ্রেটা থর্নবার্গ। ইতিমধ্যেই তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবী ধ্বংস হবে জেনেও রাজনীতিকেরা কিছু করছেন না বলে তার অভিযোগ এবং সে কারণেই তার প্রতিবাদ। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বক্তৃতায় রাজনীতিকদের কাছে তার প্রশ্ন ছিল, ‘ব্রেক্সিটের মতো বিষয়ে তোমরা যতটা সময় দিয়েছ, মাথা ঘামাচ্ছ, আমাদের ধরিত্রীকে অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে তার কত ভাগ সময় ব্যয় করেছ?’ জ্বালানি তেল, কয়লা এবং ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনশিল্পে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। ডানপন্থী গণমাধ্যমগুলো গ্রেটা মানসিকভাবে অসুস্থ কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছে।

গ্রেটা পরিবেশবাদী আন্দোলনকে নতুন জীবন ও গতি দিয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে বিলুপ্তিবিরোধী বিদ্রোহ (এক্সটিংকশন রেবিলিয়ন) লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অভূতপূর্ব আয়োজনে অভিনব প্রতিবাদ দেখিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার, পক্ষকালের কর্মসূচির শেষ দিনে তারা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর আগে তারা ইঙ্গ-ওলন্দাজ জ্বালানি কোম্পানি শেলের প্রধান কার্যালয়কেও এক দিনের জন্য অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। লন্ডনের সবচেয়ে বড় বিপণি এলাকা অক্সফোর্ড সার্কাসের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে পুরো এক সপ্তাহ তারা সেখানে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। তবে তাদের সব কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী, কিন্তু অহিংস আন্দোলনের এত বড় আয়োজন এর আগে ব্রিটেনে আর কখনোই হয়নি।

বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে সরাতে পুলিশ হিমশিম খেয়েছে এবং লন্ডনের বাইরে থেকে তাদের আরও পুলিশ আনতে হয়েছে। একেকজন বিক্ষোভকারীকে হাত-পা ধরে চ্যাংদোলা করে সরিয়ে নিতে চারজন করে পুলিশের প্রয়োজন হয়েছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু অধিকাংশই কোনো রকমের মামলা ছাড়াই ছাড়া পেয়েছে এবং আবার বিক্ষোভে ফিরে এসেছে। পুলিশের কৌশল ব্যাখ্যা করে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, শক্তি প্রয়োগ করলে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠবে বলেই তাঁরা কোনো রকমের বাড়াবাড়ির পথে যাননি। বিবিসি রেডিওর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে লন্ডনের মেয়র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেউই জলকামান ব্যবহারের প্রস্তাবে এর আগে সম্মতি দেয়নি বলে সাবেক মেয়র বরিস জনসনের কেনা জলকামান লোহালক্কড় (স্ক্র্যাপ) হিসেবে বিক্রি করতে হয়েছে।

শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনের পরিণতিতে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে আবারও অগ্রাধিকারের তালিকায় নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘চীনা ধাপ্পা’ অভিহিতকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণে বিষয়টিতে বৈশ্বিক সমঝোতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়াতেই এখন ইউরোপীয়দের ওপর চাপটা বেশি। ইউরোপজুড়ে উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক উত্থানের আশঙ্কা যখন বাড়তি উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে, তখন রাজপথে কিশোর-তরুণদের অহিংস বিদ্রোহ আশার আলো দেখাচ্ছে।

২.
রাজপথের শক্তি আশা জাগাচ্ছে আফ্রিকাতেও। সুদান ও আলজেরিয়ার গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের গণ-আন্দোলন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রপন্থীদের উজ্জীবিত করবে বলে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। বছরের পর বছর দমন-নির্যাতনের শিকার এই দুই দেশেই আন্দোলনকারীরা ভয়ের শৃঙ্খল ভেঙে অহিংস প্রতিবাদে ক্লান্তিহীনভাবে অংশ নিয়ে পরিবর্তনের পালা শুরু করেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাঁর ক্ষমতার ভিত নাড়াতে পারেনি, রাজপথে তাঁর স্বদেশিদের অনড় প্রতিবাদ তাঁকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেনি, তাঁর ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার ভিতকে সংহত করার সব চেষ্টার পরও সুদানের সামরিক স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরকে তাঁর সামরিক বাহিনী রক্ষা করতে পারেনি। সামরিক বাহিনী বেসামরিক শাসনে উত্তরণের জন্য একের পর এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেও আন্দোলনকারীদের নড়াতে পারছে না। বিক্ষোভকারীরা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পালা করে রাজপথ দখলে রেখেছে। তা-ও অন্য কোথাও নয়, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে। সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান থেকে শুরু করে জান্তার জনাপাঁচেক কর্মকর্তার পদত্যাগেও বিক্ষোভকারীরা সন্তুষ্ট নয়। গণতন্ত্রে উত্তরণে পুরোনো জান্তার কর্তৃত্ব খর্ব করতে তারা যে পথ নিয়েছে, তার লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রেজিম চেঞ্জ।

বাংলাদেশের স্বৈরশাসক এরশাদের সেনাশাসন অবসানের লক্ষ্যে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সুদানের এই আন্দোলনের হয়তো কিছুটা মিল পাওয়া যাবে। কিন্তু আপাতদৃশ্যে মনে হচ্ছে, সুদানের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব অনেক বেশি প্রাজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান। তারা শুধু কসমেটিক বা আলতো একটা পরিবর্তনে তুষ্ট নয়। তারা বুঝতে পারছে যে পরাস্ত জান্তার সুবিধাভোগীরা টিকে থাকলে তারা সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ভবিষ্যতে প্রতিশোধ নিতে বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় তফাত হচ্ছে, সুদানের আন্দোলনটির সূচনা করেছে নাগরিক সমাজ। সুদানের এই আন্দোলনের আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিপুলসংখ্যায় নারীর অংশগ্রহণ। এসব নারীর অধিকাংশেরই সন্তান অথবা স্বামী কিংবা পিতা হয় রাজবন্দী হয়ে আছেন অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা বা গুমের শিকার হয়েছেন।

ওমর আল বশির ক্ষমতায় আসেন ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এবং তারপর গঠন করেন রাজনৈতিক দল সুদান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ২০১০ সালে নতুন সংবিধান তৈরির পর থেকে দেশটিতে ৫ বছর পরপর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিরোধীদের বয়কটের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে অবসরের কথা বলেছিলেন। কিন্তু গত ডিসেম্বরে তিনি আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। দারফুর অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে সেখানে গণহত্যা এবং ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটে, তার নির্দেশদাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন ২০০৯ সালে। জারি করেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এটিই আইসিসির প্রথম এ রকম পদক্ষেপ। কিন্তু তিনি আফ্রিকার অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা এবং চীন ও রাশিয়ার সমর্থন ও প্রশ্রয়ের কারণে প্রায় ৯ বছর নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ধরে রাখেন।

আফ্রিকার এই গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের নবযাত্রায় আলজেরিয়ার আন্দোলনেও সুদানের সঙ্গে দারুণ মিল পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলনকারীরা বুতেফ্লিকা আমলের কাউকেই আর বিশ্বাস করছে না। পাঁচবার টানা ক্ষমতায় থাকা বুতেফ্লিকা শারীরিকভাবে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়া সত্ত্বেও আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আবারও প্রার্থী হতে চাওয়া থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত। এখানেও আন্দোলনের মূল শক্তি ছাত্র-তরুণেরা। তারা দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে এবং বুতেফ্লিকার পদত্যাগের পর এখনো প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে।

আলজেরিয়ায় বহুদলীয় নির্বাচন শুরু হয় ১৯৯০ সালে। কিন্তু ২০০৮ সালে দেশটির সংবিধান থেকে প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের সীমা তুলে দেন বুতেফ্লিকা। ওই সংশোধনীর পর ২০০৯ সালের নির্বাচনটি হয় অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকায় দেশটির রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা ক্রমেই খর্ব হতে থাকে। কিন্তু বিপুল জ্বালানিসম্পদ সত্ত্বেও দেশটির অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত গতি ও কর্মসংস্থান ঘটেনি। তরুণদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেকারত্বের শিকার।

সুদান ও আলজেরিয়া—এই দুই দেশেই চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। আফ্রিকায় সুদানই হচ্ছে চীনের সর্বাধিক আর্থিক সহায়তা লাভকারী দেশ। পাশাপাশি সুদান ও আলজেরিয়া হচ্ছে চীনে জ্বালানি রপ্তানিকারী দেশ। ২০০০ সালের পর থেকে ১৭ বছরে চীনে আলজেরিয়ার জ্বালানি রপ্তানি বেড়েছে ৬০ গুণ। স্বাভাবিকভাবেই বশির এবং বুতেফ্লিকা এত দিন চীনের সমর্থন পেয়ে এসেছেন।

৩.
একদিকে পৃথিবীর ধ্বংস ঠেকাতে ইউরোপের রাজপথ জেগে উঠেছে, অন্যদিকে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে জেগেছে আফ্রিকা। আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমর্থন, এগুলোর চেয়েও যে জনগণের প্রতিবাদ বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর, তার প্রমাণ দিচ্ছে সুদান ও আলজেরিয়া। গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কত্বের শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সূচনা ঘটেছিল এশিয়ায়—দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে। কিন্তু চলতি শতাব্দীতে গণতন্ত্রের যে ক্ষয়সাধন শুরু হয়েছে, তা থেকে ফেরানোর পালায় আফ্রিকাই অগ্রণী হয়ে রইল।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক