কেমন আছে রোল মডেল বাংলাদেশ

৪ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদন বেরিয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে একটি। প্রথম ৪টি দেশ হলো ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, ভুটান ও ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতি বাড়বাড়ন্ত—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বৃহৎ অর্থনীতির ক্ষুদ্র মানুষগুলো অর্থনীতির ভারী চাকাটা চালাতে গিয়ে বাঁচল না মরল, সেই প্রশ্নটা করব না আমরা?

প্রতিবেদন বলছে, অর্থনীতি বাড়ছে, তার প্রধান কয়েকটি কারণ হলো ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’, ‘কনস্ট্রাকশন’, ‘বাম্পার ক্রপ হারভেস্ট’ আর ‘রেমিট্যান্স’। এই খাতগুলো আমরা চিনি, জানি। এই খাতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকেও আমরা চিনি, জানি। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং মানে আমাদের মিরপুর, গাজীপুর, আশুলিয়ার গার্মেন্টসের মেয়েরা। ‘কনস্ট্রাকশন’ মানে আমাদের রোদে পোড়া নির্মাণশ্রমিক। ‘বাম্পার হারভেস্ট’ মানে ফলনের পর ফসলের দাম না পাওয়া কৃষক। আর ‘রেমিট্যান্স’ মানে কম খাওয়া, ঋণের বোঝা মাথায় নেওয়া প্রবাসী শ্রমিক। তো আমাদের ‘হেভিওয়েট’ অর্থনীতিটির চাকা ঘোরানো মানুষগুলো কেমন আছে?

দেশের ৮০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয় পোশাকশিল্প, অথচ কয়েক মাস আগেও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পেতেন বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) মিরপুর, গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার বাসাভাড়া, পানির লাইন, চাল, ডাল, তরিতরকারি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, মেডিকেল, পরিবহন খরচ—এসব আমলে নিয়ে হিসাব করে দেখিয়েছে, ঢাকার আশপাশের শহরগুলোয় শ্রমিকের মজুরি হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৩ হাজার টাকা। আর ঢাকার মধ্যে ১৬ হাজার টাকা। পোশাকশিল্পে চতুর্থ আর পঞ্চম গ্রেডের শ্রমিকেরা (সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি) বেতন বাড়ার পরও মজুরি পাচ্ছেন মাত্র আট হাজার টাকা। অক্সফাম দেড় হাজার ফ্যাক্টরিতে জরিপ চালিয়ে দেখিয়েছে, ক্রমাগত ওভারটাইম করার পরও বাংলাদেশের ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জন পোশাকশ্রমিকই বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না। ১০ জন পোশাককর্মীর মধ্যে নয়জনেরই তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই, ৮৭ শতাংশ পোশাকশ্রমিকই ঋণগ্রস্ত, ৫৬ শতাংশ পোশাকশ্রমিক বাকিতে জিনিস কিনতে বাধ্য হন। এ ছাড়া বিরতিবিহীনভাবে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে পিঠব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা এবং মূত্রনালির সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে, এই মাসেই নিট-পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ শ্রমিকদের ‘পুষ্টি রক্ষা’র এক অভিনব প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দুই লাখ নারী শ্রমিককে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়াবে তারা। তো হঠাৎ করে শ্রমিকদের আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ল কেন?

গাজীপুর বা আশুলিয়ার যেকোনো একটি কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে দেখুন, পোশাককর্মীরা শাকপাতা ছাড়া আর কিছু কেনার সামর্থ্য রাখেন কি না? মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল কিনতে পারেন কি না? আইসিডিডিআরবির (২০১৮) জরিপ বলছে, নারী শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই আমিষ আর আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা আর অপুষ্টিতে ভুগছে। খালেদা নামের একজন পোশাককর্মী আমাদের জানিয়েছিলেন, সারা দিনের বিক্রি না হওয়া সস্তা দামের বাসি আর অর্ধপচা মাছ বহু পোশাককর্মীর একমাত্র আমিষের জোগান।

প্রতিবারই বলা হয়, পোশাক খাতে মজুরি বাড়লে রপ্তানিতে ধস নামবে। কিন্তু আসলে কি তাই? গত এক যুগে তিন হাজার টাকা থেকে বেড়ে আট হাজার টাকা হয়েছে মজুরি। এবং এই সময়ে পোশাক রপ্তানিও ক্রমাগত বেড়েছে (২০০৮ সালে পোশাক খাতের আয় ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ১০ বছরের মাথায় রপ্তানি আয় তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার। আবার তিন দশকে এই শিল্পের মালিকেরা সম্পদের পাহাড় গড়লেও আশির দশক থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটি টাকাও ট্যাক্স দিতে হয়নি তাঁদের। বরং বছর বছর ক্যাশ প্রণোদনা পেয়েছেন ২ থেকে ৫ শতাংশ হারে। অন্যদিকে, তিন দশক ধরে পোশাককর্মীরা ঠিকমতো খেতে পান না, শুক্রবারে ছুটি পান না, একটানা ১২ ঘণ্টা কাজ করেন, টয়লেট চেপে রাখেন, ‘ইউরিন ইনফেকশন’, ‘ব্যাকপেইন’, অপুষ্টি, ও রক্তশূন্যতায় ভোগেন, আর এসব কারণে উৎপাদনশীলতাও কমে। এবং শেষ পর্যন্ত ফলিক অ্যাসিড/আয়রন ট্যাবলেট খাইয়ে অপুষ্টিতে ভোগা ক্ষয়িষ্ণু মেয়েগুলোকে কোনোমতে টিকিয়ে রাখার প্রজেক্ট হাতে নিতে হয়।

প্রতিবছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিন হাজারের বেশি লাশ ফেরে কফিনে। প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। অথচ প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জিডিপির ৭ শতাংশ। সরকারি সূত্র বলছে, বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হৃদ্‌রোগ বা স্ট্রোক। অথচ এই শ্রমিকদের বয়স মাত্র ২৫ থেকে ৩০–এর মধ্যে! হাজার হাজার কর্মক্ষম টগবগে তরুণের এই ভয়ংকর পরিণতি কেন? বিশ্বব্যাংক আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের অভিবাসন খরচ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। যেমন: কুয়েত যেতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের লাগছে দেড় থেকে চার লাখ টাকা, যা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের তুলনায় অনেক বেশি। এর মধ্যে আবার মোট খরচের ৭৭ শতাংশ লুটে নিচ্ছে দালাল চক্র। এই চক্রের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। টাকা জোগাড় করতে কেউ চড়া সুদে ঋণ করেন, কেউ জমি জমা বিক্রি করেন। এরপর চক্রাকারে বাড়তে থাকে সুদের বোঝা। তার ওপর আবার ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও পর্যাপ্ত মজুরি পান না শ্রমিকেরা। অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রম, অল্প খাবার, ঋণের বোঝা—এরপর মারাত্মক দুশ্চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক—এভাবেই মরে যাচ্ছেন একটি হতদরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে গায়ে–গতরে সচল রাখা তরুণ শ্রমিকেরা।

আপনি বলবেন, যেহেতু বিদেশের মাটিতে এসব ঘটছে, কী করার আছে বাংলাদেশের। অথচ প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ হলো, ভয়াবহ সংকটেও শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় না দূতাবাসগুলো। বছরের পর বছর এভাবে অসংখ্য তরুণ শ্রমিকের মৃত্যুর পরেও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের কোনো রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা নেই। এতগুলো লাশের পেছনের কারণ আসলেই হৃদ্‌রোগ, নাকি মালিকপক্ষের অবহেলা বা কর্মক্ষেত্রের ‘দুর্ঘটনা’—এসব খতিয়ে দেখারও এতটুকু দায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করেছে শ্রীলঙ্কা ২০১৩ সালেই। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া আর নেপাল নিজ নিজ দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের মজুরি আর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে মেরুদণ্ড সোজা রেখে দর-কষাকষি করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে। অথচ আমাদের এখানে গত দেড়-দুই বছরে শুধু সৌদি আরব থেকেই ভাঙা হাত-পা, ছ্যাঁকা খাওয়া শরীর আর ধর্ষণের শিকার হয়ে ফেরত এসেছেন হাজার খানেক নারী শ্রমিক। মেয়েগুলোকে ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে, ছেলেগুলোকে টুপটাপ মরে যাওয়া থেকে বাঁচাতে আজ পর্যন্ত কী করেছে দূতাবাসগুলো? কী করেছে সরকার? নাকি রেমিট্যান্সের লোভে মেরুদণ্ডটাই বেচে দিয়েছে? শুধু রেমিট্যান্সই নেবেন? লাশের দায় নেবেন না?

জিডিপির ১৪ শতাংশ আমাদের নির্মাণ খাত। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাড়বাড়ন্ত অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক দেশের নির্মাণশিল্প। অথচ ১০–১৫ তলার ওপরে ‘স্পাইডারম্যান’–এর মতো ঝুলে ঝুলে কাজ করেন মধ্য আয়ের দেশের হাজারো নির্মাণশ্রমিক। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, বহুতল ভবন থেকে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে বছরে শতাধিক নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে। এসব কি স্বাভাবিক মৃত্যু? নাকি হত্যা? সামান্য একটি হেলমেট, একটি সেফটি বেল্ট এবং একটি সেফটি নেট থাকলেই শ্রমিকের জীবন বাঁচে। উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের কটা দালানে জান বাঁচানোর এই ন্যূনতম সরঞ্জামগুলো থাকে? নাকি উন্নয়নের দেশে শ্রমিকের জীবনের চেয়ে হেলমেটের দাম বেশি?

কৃষি জিডিপির ১৪ শতাংশ এবং দেশের জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি মানুষ জড়িয়ে আছে কৃষির সঙ্গে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, পরপর কয়েক বছর বাম্পার ফলনের ফলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু প্রতিবার বাম্পার ফলনের পর কৃষকের যে বাম্পার দুর্ভোগ হয়, সেই ‘রিপোর্ট’ কোথায়? জমির লিজ, বীজ সংগ্রহ, খেতমজুরের পারিশ্রমিক, সেচ, কীটনাশক, ইউরিয়া, পটাশ—এসব বহুমুখী খরচের পর প্রতিবছর লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করেন কৃষক। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো কী করে? ন্যায্যমূল্যে ধান কেনে কৃষকের কাছ থেকে? পটুয়াখালীর একজন কৃষক জানিয়েছিলেন, ফড়িয়া–মজুতদারের চেয়েও মণপ্রতি ১০০ টাকা কম দেয় সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো। বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের হাইওয়ের দেশে, বিশ্বের ‘কুইকেস্ট গ্রোইং’ টাকাওয়ালাদের দেশে, বিশ্বের ১৮তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশে, বছরের পর বছর নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ান বাম্পার ফলানো হতভাগা কৃষক। স্যাটেলাইট কেনা যায়, সাবমেরিন কেনা যায়, রাশিয়ান মিগ আর চাইনিজ ফাইটার জেট কেনা যায়, কেনা যায় না শুধু মণপ্রতি ৫০০ টাকায় ঘামে জবজবে কৃষকের ধান?

আমরা বারবার বলার চেষ্টা করছি, অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা মানেই মানুষের অবস্থার উন্নয়ন নয়। বরং মধ্যআয় আর ৮ শতাংশ জিডিপির বাগাড়ম্বরের আড়ালে চাপা পড়ে থাকছে অগণিত শ্রমজীবী মানুষের বিপর্যয়ের গল্প। নগরীর এক প্রান্তে বিএমডব্লিউ, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৮ শতাংশ, অথচ আরেক প্রান্তে কেন এত অগণিত অকালমৃত্যু? কেন নির্মাণশ্রমিকের জন্য থাকে না সামান্য সেফটি নেট? কেন ভাত-মাছের বদলে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়াতে হয়? কেন ১৩ বছরে কফিনে চেপে দেশে ফেরে ৩৩ হাজার তরুণের লাশ? জবাব দিক উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ।

মাহা মির্জা: গবেষক ও অ্যাকটিভিস্ট