বিএনপির সাংসদদের শপথ প্রশ্নে অবাস্তব প্রত্যাশা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত চার নেতাকে শপথ পড়ান স্পিকার শিরিন শারিমন চৌধুরী। সংসদ ভবন, ঢাকা, ২৯ এপ্রিল। ছবি: জাতীয় সংসদের সৌজন্যে
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত চার নেতাকে শপথ পড়ান স্পিকার শিরিন শারিমন চৌধুরী। সংসদ ভবন, ঢাকা, ২৯ এপ্রিল। ছবি: জাতীয় সংসদের সৌজন্যে

বিএনপির অর্ধডজন সাংসদের পাঁচজন শপথ নিয়ে একাদশ সংসদে যোগ দেওয়ায় যে অবিশ্বাস ও বিস্ময়সূচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এটা প্রত্যাশিত ছিল না। কেন তা প্রত্যাশিত ছিল না, সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়। যাঁরা ধারণা করেছিলেন যে বিএনপি শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে, বিএনপির প্রতি তাঁদের এই বিশ্বাস বা আস্থা বিস্ময়কর।

শপথ না নেওয়ার বিষয়টি বিএনপির অঙ্গীকার ছিল নাকি হুমকি ছিল—প্রথমত সেটি বিচার করা দরকার। বিষয়টিকে দলের নেতাদের অনেকেই একটি অঙ্গীকারের মতো করে প্রচার করেছেন। কিন্তু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ছাড়া ওই ছয়জনের অন্য কেউ শপথ নেবেন না এমন কোনো ঘোষণা দিয়েছেন বলে কোনো খবর চোখে পড়েনি। বিপরীতে একটা জোরালো ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে হুমকি দিতেই এ কথাটি বলা হচ্ছে। পাঁচজন সাংসদ ও দলীয় মহাসচিবের ব্যাখ্যায় এখন প্রমাণ হচ্ছে দ্বিতীয় ধারণাটিই ঠিক ছিল। তবে দর-কষাকষিতে তাঁরা কিছু পেয়েছেন কি না, দেশবাসীর কী লাভ হলো সেসব প্রশ্ন আলাদা। মির্জা ফখরুলের শপথ না নিয়ে আসন হারানোতে অবশ্য তাঁর দলের অভ্যন্তরীণ সংকটের তীব্রতারই ইঙ্গিত মেলে। 

যাঁরা বিএনপির ‘হুমকি’কে অঙ্গীকার ভেবে দলটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিলেন যে নির্বাচনের আগে দলটি তাতে অংশ নেওয়ার শর্ত হিসেবে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছিল। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো আশ্বাস না পেলেও দলীয় নেত্রীকে মুক্ত করার সংগ্রামের অংশ হিসেবে সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কয়েক দফা দাবি পেশ করে দলটি বলেছিল যে শর্তগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু শর্তগুলো পূরণের বিষয়ে কোনো ধরনের আশ্বাস ছাড়াই তারা ‘চমক ‘দেখিয়ে দলীয় প্রধানকে মুক্ত করার আন্দোলনের অংশ হিসেবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে নানা ধরনের অনিয়মের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে ক্রমাগত অভিযোগ করার পরও তারা নির্বাচন থেকে আর সরে যায়নি। রাতের বেলার ভোটের ফলকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার কথা বললেও একাদশ সংসদের ৯০ দিনেও তারা সরকারের জন্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেনি। এমনকি তাদের প্রতি জনসমর্থনের মাত্রাটাও প্রদর্শিত হয়নি। নিকট অতীতের এসব ঘটনাপ্রবাহের পরও বিএনপির প্রতি অগাধ আস্থা রেখে যাঁরা আজ হতাশ হয়েছেন তাঁদের শুধু সমবেদনাই প্রাপ্য!

আর শপথ না নেওয়ার হুমকিটা যদি দর-কষাকষির কৌশলের বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী তা আমরা জানি না। দলীয় প্রধানের মুক্তি, নেতা-কর্মীদের হয়রানি-দুর্ভোগের অবসান, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার অর্জন ইত্যাদি যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অপেক্ষায় থাকার বিকল্প আর কী আছে? তবে অতীত অভিজ্ঞতাকে মূল্য দিলে দলটির দর-কষাকষির যোগ্যতার বিষয়ে যাঁরা আশাবাদী হবেন তাঁদেরও উচিত হবে প্রত্যাশার লাগাম টানা।

বিএনপির অভিযোগ ছিল যে সাংসদদের ওপর শপথ গ্রহণের জন্য অসহনীয় মাত্রায় চাপ ছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের অন্যরা সে রকম চাপের কথা নাকচ করে দিয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজনীতিতে অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপের বিষয়টি সবারই জানা। এসব সাংসদকে সংসদে নেওয়ার চেষ্টায় সফল হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং যেসব কথিত ‘অদৃশ্য শক্তি’ তৎপর ছিল তারা বাহবা নেবে সন্দেহ নেই।

কিন্তু যে কথাটি মনে রাখা দরকার তা হোলো দেশে বিএনপির ভক্ত-অনুসারীদের চেয়ে বিএনপিতে ভরসা না রাখা সরকারবিরোধীর সংখ্যা মোটেও কম নয়। মানুষের ভোটাধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-গ্রেপ্তার-নির্যাতন-হয়রানিসহ নানা ধরনের অন্যায়-অবিচারের অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ক্ষোভ কেবলই পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এক হাতে গোনা যায় এমন কজন বিরোধী সাংসদের সংসদে যোগদান তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার নিশ্চয় ইতি ঘটাচ্ছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক