ঐতিহাসিক 'আবুসিনা ছাত্রাবাস' রক্ষা করুন

সিলেটের ঐতিহাসিক ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস’ ভবন
সিলেটের ঐতিহাসিক ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস’ ভবন
>

সিলেটের ঐতিহাসিক ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস’ ভবন ও তার পরিসর সম্পূর্ণভাবে রক্ষার্থে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, সিলেট কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরেছেন সৈয়দা জেরিনা হোসেন, রাজন দাস, কৌশিক সাহা, রেজওয়ান সোবহান, তৌফিক ইলাহী, শওকত জাহান চৌধুরী, শুভজিত চৌধুরী। 

সিলেটের ঐতিহাসিক ‘আবুসিনা ছাত্রাবাস’ ভবন ও তার পরিসর সম্পূর্ণভাবে রক্ষার্থে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, সিলেট কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নানান জাতি ও ভাষার সমাবেশ এবং ভবন-নির্মাণশৈলীর বিশেষ ঐতিহ্য
নিয়ে সিলেট বাংলাদেশের এক অনন্য নগরী। এসব কারণে সিলেট দেশি ও বিদেশি পর্যটকের একটি প্রধান গন্তব্য। একটি নগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপভোগ করার জন্যই পর্যটকেরা ভ্রমণে আসেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নগর পরিসর ও এর ভবনাদি।

সিলেটের প্রথম মেডিকেল কলেজ, যেটা আবুসিনা ছাত্রাবাস নামে ইদানীং পরিচিত, তা চরম অবহেলা ও অযত্নে দাঁড়িয়ে থাকলেও এর ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব অপরিসীম। দেড় শ বছরের বেশি আগের এই ভবনের বর্ণিল ইতিহাস নানা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবনটি ব্রিটিশ ও অসমীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি সিলেট অঞ্চলের অনন্য স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি। আনুমানিক ১৮৫০ সালে খ্রিষ্টান মিশনারির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল হিসেবে ভবনটি নির্মিত হয়। ১৯৭২ সাল থেকে সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ভবনটি ব্যবহৃত হচ্ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া স্থাপনাটি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার স্মৃতিও বহন করে। অথচ পরিতাপের বিষয়, সম্প্রতি সিলেটের এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ ভেঙে জেলা হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থপতি ও নগরবিদ হিসেবে আমরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই এবং এই স্থাপনা ও পরিসরকে রক্ষা করার দাবি জানাই।

সিলেট একটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা এবং দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত এখানেই হয়। ভূমিকম্প ও অতিবৃষ্টিকে বিবেচনায় রেখে আসাম-প্যাটার্নের টাওয়ারসহ নানা স্তরে লাল টিনের ছাদ, খিলান, জানালা ও অন্যান্য কাঠামোগত উপাদান এর জ্যামিতিক অনুপাত নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত করে নির্মিত একটি দৃষ্টিনন্দন ভবনের উদাহরণ হলো আবুসিনা ছাত্রাবাস। এর ছাদের নির্মাণশৈলী যে দক্ষতা দিয়ে করা হয়েছে, তা এখন আর প্রচলিত নয়। এর প্রযুক্তিগত ডিটেইল শিক্ষণীয়। ভবনের মাঝখানের চত্বরের অনুপাত উন্নতমানের ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উপযোগী। এমন উন্নত ও নান্দনিক স্থাপনা ও পরিসর, যার সঙ্গে দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত, তা যেকোনো নগরের একটি অমূল্য সম্পদ। এমন স্থাপনা একটি নগরের গর্ব বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এমন ভবন ভেঙে ফেলা ও পরিসর বিনষ্ট করা একটি অপরাধ বলেই আমরা মনে করি। আমরা জানি, বর্তমান সরকার দেশের ও দশের কল্যাণ সাধনে বদ্ধপরিকর। সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই মতে সিলেটে একটি ‘২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল প্রকল্প’ গ্রহণকে আমরা অভিনন্দন জানাই। হাসপাতালের চাহিদা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু যেকোনো হাসপাতালে জরুরি সেবা পেতে বছরের ৩৬৫ দিন সড়কে যাতায়াতে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, এমন স্থান নির্বাচন অত্যাবশ্যকীয়। সেখানে নীরবতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যেন বিরাজ করে তা বিবেচনা করতে হবে। অথচ প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থানটির চতুর্দিকে যে স্থাপনাগুলো বিরাজমান এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যে কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, তা একটা হাসপাতালের জরুরি যাতায়াত বা নীরবতা রক্ষা নিম্নলিখিত কারণে নিশ্চিত হবে না।

প্রথমত, প্রস্তাবিত প্রকল্প সাইটের দক্ষিণ পাশে হজরত শাহজালাল (র.)–এর দরগা শরিফ ও ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা মাঠ। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা তাঁদের নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন ওই মাজার জিয়ারত ও মাদ্রাসা মাঠে জনসভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে এবং এর জন্য সিলেটবাসী গর্বিতও। কিন্তু শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ওই সাইটের সামনের রাস্তায় প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত থাকে প্রায় তিন দিনের মতো, স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ থাকে। বছরজুড়ে এই মাঠে ওয়াজ মাহফিল, জনসভা, মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক জন-যাতায়াত তখন ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়। এবং উচ্চমাত্রায় যে শব্দদূষণ হয় তা একটি হাসপাতালের জন্য সঠিক স্থান হতে পারে না।

প্রস্তাবিত সাইটের সম্মুখ রাস্তার পশ্চিম মোড়ে ৩০ হাজার দর্শক ধারণক্ষম বিভাগীয় ক্রীড়া স্টেডিয়াম ও একটি ৭৫০ আসনের অডিটরিয়াম রয়েছে। স্বভাবতই এই স্থাপনাগুলোতে অনুষ্ঠান হলে যে জনসমাগম হয়, তাতে প্রস্তাবিত হাসপাতালে প্রবেশ করা কঠিন হবে। ওই সাইটের এক থেকে দুই কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ সরকারি ও বেসরকারি একাধিক হাসপাতাল বিরাজমান। আর এর গা ঘেঁষেই রয়েছে সিলেট সদর হাসপাতাল। তাই জনসেবাপ্রাপ্তির কথা বিবেচনা করলে এই স্থানে হাসপাতাল নির্মাণ কোনোভাবেই হতে পারে না।

 আমরা সিলেট নগরীর বধর্নশীল এলাকায় প্রস্তাবিত হাসপাতালের স্থান নির্বাচন করার জন্য প্রস্তাব করছি। এয়ারপোর্ট রোড, সুনামগঞ্জ সড়কের আশপাশ অথবা পরিত্যক্ত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের জায়গাতে হতে পারে এই প্রস্তাবিত নতুন হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত স্থান। এতে করে নগরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুষমভাবে প্রদান সহজতর হবে। স্থপতি ও নগরবিদ হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষা করে এবং সমতাভিত্তিক, কার্যকর ও উন্নতমানের নগর ও জনবসতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবনকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্থাপত্য-সংরক্ষণ রীতি মেনে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা সম্ভব।

 উন্নতমানের নগর নির্মাণের স্বার্থে আমরা আশা করব কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থাপনা নির্মাণের স্থান নির্বাচন যেন পরিকল্পনা করে করা হয়। সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য সিলেট সিটি করপোরেশনে স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ, ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিসমেত যাতে একটি ‘ঐতিহ্য কমিটি’ গঠন করা হয়, আমরা সেই প্রস্তাব করছি। এই কমিটি বিভিন্ন ঐতিহ্য চিহ্নিত করা ও ধারাবাহিকভাবে তা রক্ষা ও নান্দনিক পরিসর সৃষ্টিতে নগর প্রশাসনকে সহায়তা করবে।

আজ যাঁরা দেড় শ বছর বয়সী ইতিহাসবিজড়িত স্থাপত্যকর্মকে নেহাত একটা ভগ্নদশা অকার্যকর পুরোনো বাড়ি ভাবছেন এবং ১৫ তলা হাসপাতালকে মানবকল্যাণের প্রতীকরূপে দেখছেন, তাঁরা মহান স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজতলা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতিধারণকারী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানকে মুছে ফেলে ‘শিশুপার্ক’ নির্মাণের কথা একটিবার স্মরণ করুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আমাদের ধিক্কার না দেয় তা দেখতে হবে। আমরা যেন আর বিভ্রান্ত না হই, আত্মঘাতী হয়ে না উঠি।

লেখকেরা: স্থপতি