সুদানে বশিরের পতন, সেনা ও জনতা দ্বন্দ্ব

সুদানে আন্দোলনকারীদের ক্ষমতা দখলকারী সেনাবাহিনী সতর্ক করে বলেছ, আর কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। বামপন্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন ছিল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। লৌহমানব প্রেসিডেন্ট হাসান আল বশিরকে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার বসানোর জন্য না। কিন্তু মুসলিম দেশে বামপন্থীদের উত্থান ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে নামিয়ে দিয়েছে পশ্চিমারা। সুদানে নতুন ধরনের এক সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে হাসান আল বশিরের বিরুদ্ধে। হাল আমলে অভ্যুত্থানের ধরন বদলেছে। জনসাধারণের হাত ধরেই সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। কোথাও কোথাও সরাসরি সামরিক শাসন জারি করা হয়। আবার কোথাও থাকে ছদ্ম সামরিক শাসন। এই ছদ্ম সামরিক শাসনে বেসামরিক লোকজনের কাছে শাসনের দায়িত্ব থাকলেও পর্দার আড়াল থেকে সামরিক বাহিনীই সব ঠিক করে দেয়।

গত শতকের সত্তর বা আশির দশকে হরহামেশাই গণমাধ্যমের খবর ভেসে আসত অমুক দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এরপর যথারীতি সামরিক বাহিনীর তরফে জানানো হতো; ক্রান্তিকালে দেশ ও জাতিকে রক্ষা ও উদ্ধার করার জন্য দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হাতে তুলে নিয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতার মঞ্চে চলে আসত। বলা বাহুল্য, বেশির ভাগ অভ্যুত্থানই রাতের আঁধারে সংগঠিত হতো। ফলে, সকালের উঠেই ওই সব দেশের নাগরিকেরা দেখত নতুন এক সরকার দেশের মাথায়। মোড়ে মোড়ে সামরিক সদস্যরা পাহারা দিচ্ছে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শাসক পালিয়েছেন। অথবা জেলবন্দী বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ওই সময়কার দুই পরাশক্তির স্নায়ুর লড়াইকালে ছায়াযুদ্ধের ফল হচ্ছে এসব অভ্যুত্থান। মূলত এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই সামরিক অভ্যুত্থান বেশি হয়েছে। কোনো দেশের সরকারকে কোনো কারণে হুমকি মনে হলেই দুই পরাশক্তি সামরিক বাহিনী দিয়ে অভ্যুত্থান সংগঠিত করত। অভিযোগের তির অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ও গোয়েন্দা সহযোগিতায় গত শতকে বেশ কয়েকটি নির্মম ক্যু সংগঠিত হয়। এর মধ্যে চিলি, ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক অভ্যুত্থান আলোচিত ছিল। বামপন্থী সরকার ও দলগুলোকে হঠাতে চিলি, ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার অভ্যুত্থানে সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার অভ্যুত্থান নিয়ে গবেষণা করছে। ওয়ান আর্থ ফিউচার জানাচ্ছে, গত শতকের তুলনায় এই শতকের চলতি বছর পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানের হার ৮০ শতাংশ কমেছে। মূলত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই অভ্যুত্থানের হার কমেছে। একই সঙ্গে অভ্যুত্থানের ধরনও বদলেছে। এখন আর রাতের আঁধারে তেমন হয় অভ্যুত্থান হয় না। বা হলেও তেমন সফল হয় না, যেমন তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান। বরং জনগণের কাঁধে পা দিয়ে দিনে–দুপুরে অভ্যুত্থান হয়।

আরব বসন্তের দিকে তাকালেই এর নজির পাওয়া যাবে। আরবের রাজনীতিকে নাড়া দিয়েছিল আরব বসন্ত। আজ প্রায় এক দশক পর আরব বসন্ত শেষ পর্যন্ত কী পরিবর্তন আনতে পারল, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আরব বসন্ত যেমন আরবের গণতান্ত্রিক চেতনাকে তুলে ধরেছে, আবার কয়েকটি দেশে সামরিক শাসনের পুনর্বহাল ও সন্ত্রাসী তৎপরতাও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলই উদ্যোক্তারা ভোগ করতে পারেন না বা গোটা আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। গণতন্ত্র, সম–অধিকারের আন্দোলনে শুরু হওয়া আরব বসন্ত তেমনই এক আন্দোলন। এই আন্দোলন আর শেষ পর্যন্ত জনগণের দখলে ছিল না। সিরিয়ায় চলে গিয়েছে জঙ্গিদের হাতে। আর মিসরে ফের সামরিক সরকার ক্ষমতায়। সামরিক শাসক আবদেল ফাত্তাহ সিসি এখন ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করছেন। এই সিসি কিন্তু জনগণের কাঁধে ভর করেই ক্ষমতা দখল করেছেন। তুরস্কে সেনাবাহিনী পা রাখার মতো জনগণের শক্ত কাঁধ পায়নি। তাই শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা আরোহণের পথে এখন সুশীল সমাজ ও সাধারণ জনতাও জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। এই প্রক্রিয়ার শুরুতেই শাসক দলের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সাধারণ জনতা পথে নামে। টানা আন্দোলন চলতে থাকে। এর সঙ্গে সুশীল সমাজও বক্তৃতা–বিবৃতির মাধ্যমে যোগ দেয়। প্রথম দিকে সেনাবাহিনী শাসক দলের সঙ্গেই থাকে। রাজনৈতিক শাসক সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই সব বৈঠকের ছবি ফলাও করে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আন্দোলন আরও ঘনীভূত হয়। এই সব আন্দোলনের একপর্যায়ে বিদেশি দূতাবাসগুলোরও কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। এরা সরকারের কী করা উচিত বা কী করা উচিত না, এসব বিষয়ে পরামর্শ দিতে শুরু করে। কখন কখনো জাতিসংঘের মিশনগুলোও কথা বলতে শুরু করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বৈঠক করে। ভাবখানা অনেকটাই এ রকম যে তারা সবাইকে বুঝিয়ে সমঝোতায় প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এসব তৎপরতা দেখেই বুঝতে হবে পর্দার আড়ালে সামরিক ছাউনিতে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, লৌহশাসকও কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়ছেন না। তখনই দেশ ও জাতিকে উদ্ধারকল্পে এগিয়ে আসে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী। বৃহত্তর স্বার্থে লৌহশাসকের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর কখনো নিজেরাই ক্ষমতায় বসে যায়। যেমন মিসরে। আবার কখনো নিজেদের পুতুল কাউকে বসিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যেমন আলজেরিয়া। যেভাবেই হোক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করে। এভাবেই সামরিক শাসন বা ছদ্ম সামরিক শাসন কয়েক দশক পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়ে।

তবে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয়ও ঘটে। বর্তমানে সুদানে যা হচ্ছে। সুদানে এখনো আন্দোলনকারীরা মাঠে রয়েছে। লৌহমানব হাসান আল বশিরের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল সুদানের জনসাধারণ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন কারণেই বশিরের বিপক্ষে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। আন্দোলনে যখন তুঙ্গে, তখনই সামরিক বাহিনী বশিরকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। তবে সুদানের জনসাধারণ মিসরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তাই এখনো আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে যায়নি। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এখনো আন্দোলন করে যাচ্ছে। সামরিক অভ্যুত্থানের ধরন বদল হলেও আন্দোলনের ধরন খুব বেশি বদল হয় না। কালে কালেই মুক্তিকামী জনতা মাঠে থাকে। আন্দোলনের ফসল ছিনতাই হয়ে গেলেও হতাশ হয় না। কখনো নূর হোসেন, কখনো বোয়াজিজি বা কখনো সাঈদ খালিদের রূপ ধরে বাংলাদেশ, তিউনিসিয়া, মিসরে বারবার ফিরে আসে। জাতি–বর্ণ–ভিন্ন হলেও এদের পরিচয় একই, এরা সামরিক বা বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি চায়।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন