হালদায় তেল দূষণ, নদী কমিশন নড়ুন-চড়ুন

হালদায় পড়েছে এসব খাল, পানিতে মেশা বিষাক্ত ফার্নেস তেল ঠেকানোর চেষ্টা যেন বালির বাঁধ। ছবি ডেইলি স্টার
হালদায় পড়েছে এসব খাল, পানিতে মেশা বিষাক্ত ফার্নেস তেল ঠেকানোর চেষ্টা যেন বালির বাঁধ। ছবি ডেইলি স্টার

পৃথিবীতে হালদা একটাই আছে। মিষ্টি পানির মাছের এত বিরাট প্রজননক্ষেত্র আর নেই। অথচ এই নদীর ওপর অত্যাচার থেমে নেই। এবার পা পিছলে আলুর দম হওয়ার অবস্থা হয়েছে তেলভরা রেল ওয়াগনের। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র পিকিং প্ল্যান্টের জন্য ফার্নেস অয়েল ভরা রেল ওয়াগন আবার লাইনচ্যুত হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল ভরদুপুরে সাতটি রেল ওয়াগনের মধ্যে তিনটি কালভার্ট ভেঙে মরাছড়া খালে পড়ে। প্রতিটি ওয়াগনে প্রায় ৩৫ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল থাকে। হাটহাজারী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাওয়ার সময় মরাছড়ার ওপর যে কালভার্ট রয়েছে, তার পাটাতন ও স্লিপার ভেঙে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার (৩৫ X ৩) লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়াসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক চেষ্টার পরেও ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল বিভিন্ন ছড়া হয়ে হালদা নদীতে পড়ার আশঙ্কা এখনো দূর হয়নি। তবে হালদা নদীতে এ তেল যাতে না যেতে পারে, সে জন্য চটজলদি সাময়িক বাঁধ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দুর্ঘটনার সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হাটহাজারী উপজেলা কর্মকর্তাকে অবহিত করা হলে তিনি নদী ও সংশ্লিষ্ট খাল/ছড়াগুলোয় সাময়িক কয়েকটি (প্রায় ১৬টি) বাঁধ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বৃষ্টি না থাকায় দুর্বল এসব সাময়িক বাঁধ তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মানুষদের দিয়ে পানি থেকে ফার্নেস অয়েল ওঠানোর ব্যবস্থা করে। উদ্ধারকৃত প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ধরেছে ২০ টাকা। সংগৃহীত তেল থেকে ৯ হাজার ৬০০ লিটার তেল পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে প্রতি লিটার ২০ টাকা করে বিক্রিও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ফণীজনিত বৃষ্টিপাতের আগেই যতটা সম্ভব তেল উঠিয়ে নেওয়ার রাতদিন চেষ্টার কথা জানিয়েছেন তিনি। তবু হালদা কি আশঙ্কামুক্ত?

পরিবেশ অধিদপ্তরও এগিয়ে আসে। জোগাড় করে একটা নাতিদীর্ঘ অয়েল বুম। সেটাও কাজে এসেছে। সুন্দরবনের স্থানীয় মানুষের প্রযুক্তি ধানের খড় দিয়ে পানিতে ভাসমান তেল সরানোর তথ্য হাটহাজারীতেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আফসোস নদীগুলোর অভিভাবক নদী কমিশনের কাউকে রা করতে দেখা গেল না। অবশ্য কথায় আছে, কাজের মানুষেরা নিঃশব্দে কাজ করেন। আমরা না হয় সেটাই সত্য ধরে নিলাম।

ফার্নেস অয়েলের বিষাক্ত উপাদান পানির সঙ্গে মিশে নদীর খাদ্যচক্র নষ্ট করে, অক্সিজেনস্বল্পতার সৃষ্টি করে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে। এ কারণে প্রাণী ও মাছ মারা যায়। আবার এসব প্রাণী ও মাছ খেয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও মারা যায়। এ ছাড়া আশপাশের ফসলি জমিও মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। তেল ছড়ানো রোধ করা না গেলে হালদার বেলাতেও সেটাই ঘটবে বলে আশঙ্কা।

এমনটা ঘটেই চলেছে। এর আগে ২০১৫ সালের ১৯ জুন একই ঠিকানায় ফার্নেস অয়েল পৌঁছাতে গিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে সেতু ভেঙে খালে পড়ে যায় রেলের ওয়াগন। বোয়ালখালী খাল ও কর্ণফুলী নদীর ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় ৫০ হাজার লিটার তেল ভাসতে থাকে। পরিবেশবাদী ও হালদা বাঁচাও আন্দোলনের চাপে পরদিন বিকেল থেকে স্থানীয় লোকজন নদী ও খাল থেকে তেল অপসারণের কাজ শুরু করে। কর্তৃপক্ষ উদ্ধারকৃত প্রতি লিটারের দাম ধরেছিল ৩০ টাকা। পরে সেটা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ৬০ টাকা করা হয়। টাকা দিয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে তেল উদ্ধারে মেতে ওঠার আগে ‘অয়েল বুম’ বসিয়ে তেলের ছড়িয়ে পড়া রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু অদক্ষতার কারণে কাজ হয়নি। খাল থেকে তেল অপসারণে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মানুষ ও শ্রমিকদের ওপরই ভরসা করতে হয় প্রশাসনকে।

ফার্নেস অয়েল পরিবহন করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ ঘটতে গিয়েছিল ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর। সেদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বোয়ালখালীর গুমদণ্ডী স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ১৪ নম্বর রেলওয়ে সেতুর কাছে ফার্নেস অয়েল বহনকারী চলন্ত রেল ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। ভাগ্য ভালো, এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবে হতে পারত অনেক কিছুই।

এসব দুর্ঘটনা কি এড়ানো সম্ভব?
শিল্পকারখানা বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পরিবেশে এবং অবকাঠামো ওপর তার নানা রকম ঝুঁকি আর প্রত্যাশা তৈরি হয়। জনগণকে নিয়ে সেসব ঝুঁকি আর প্রত্যাশার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এখন যেকোনো বিনিয়োগের পূর্বশর্ত। সেসব বিশ্লেষণ আলোচনা ঠিক করে দেয় ঝুঁকি কামানোর ক্ষেত্রে আর প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে কে কতটা দায়িত্ব পালন করবে আর কীভাবে করবে। পিকিং প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ যদি প্রত্যাশা করে, রেল তার চাহিদা মোতাবেক সস্তায় তাকে তেল আর যন্ত্রপাতি এনে দেবে, তাহলে মূলত যাত্রী বহনের জন্য স্থাপিত রেল আর রেল সাঁকোগুলো টন টন তেল আর মালামাল বহনের উপযুক্ত কি না, সেটাও দেখতে হবে। যদি উপযুক্ত না হয়, তাহলে তা উপযুক্ত করার দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। বিনিয়োগের বাজেটে সেটা রাখতে হবে। স্থাপনার কাছে যদি কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের আধার, যেমন: নদী, বন, পাহাড় ইত্যাদি থাকে, তাহলে তার নিরাপত্তা আর বিকাশের পথে কোনো ঝুঁকি বা বাধা সৃষ্টি হতে পারে কি না, সেটা পরিকল্পনাপত্রের মূল অংশে থাকতে হবে। পিকিং পাওয়ারের সে এলেম না থাকলে নদী কমিশনকে সেটা দেখতে হবে।

সারা দেশের নদী রক্ষা যদি মুরাদে না কুলায়, তবে একটা দুইটা নদী নিয়ে জান–কবুল যুদ্ধে নামুন নদী কমিশন। হালদা ফার্নেসের ঝুঁকিতে পড়ার আগে এক মাস ধরে ধড়ে নানা আঘাতের চিহ্ন নিয়ে মহামূল্যবান মা মাছেরা যে ভেসে উঠছে, সেটা অন্তত আমলে নিন। রূপপুরের পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র তৈরি হলে পাবনার পদ্মা আর কুষ্টিয়া–ফরিদপুরের গড়াই, মধুমতি কী বিপদের ঝুঁকিতে পড়বে, সেটা না হয় না ভাবলেন, কিন্তু হালদা-বড়াল নিয়ে একটু সিরিয়াস হলে কিসের ক্ষতি?

শেষ কথা
সুন্দরবন, বোয়ালখালী, আর সর্বশেষ হাটহাজারী—সর্বত্র নিরুপায় কর্তৃপক্ষ পানি থেকে তেল অপসারণের সহজ পথ মানুষকে বেছে নেয়, নামিয়ে দেয় তেলের কাদায়! কোনো রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ তেল সংগ্রহ করতে দেখা গেছে এসব জায়গায়। ২০১৫ সালে বোয়ালখালীতে শিশুসহ নানা বয়সের মানুষকে শুধু টাকার লোভ দেখিয়ে তেলের কাদায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করানো অমানবিক নয়! তেলের টক্সিন পরিবেশের পাশাপাশি মানবদেহের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু কেউ শোনে না যুক্তির কথা।

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও গবেষক।
[email protected]