ফিরে পেতে চাই প্যারিসের হৃদয়

প্যারিসের এই হৃদয়ের পোড়া ক্ষত সারাতে লাগবে পাঁচটি বছর। ছবি: রয়টার্স
প্যারিসের এই হৃদয়ের পোড়া ক্ষত সারাতে লাগবে পাঁচটি বছর। ছবি: রয়টার্স

নটর ডামে দ্য প্যারিস বা বাংলায় বললে ‘আমাদের প্যারিসের মেয়েরা’। এটি শুধু ৮৫০ বছরের পুরোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের চার্চ নয়, এই স্থাপত্য প্যারিসের গৌরব, প্যারিসের অহংকার। প্যারিসে ভ্রমণে গেছেন অথচ সিন নদীর পাশে বিশাল সবুজ পার্কের পটভূমিতে গথিক শিল্পশৈলীতে তৈরি নটর ডামে ক্যাথেড্রালে দেখেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল।

ক্রিস্টিনে মিয়োঁ নামে আমার এক পরিচিত ফরাসি সুহৃদ আছেন প্যারিসে। ক্রিস্টিনে একজন ছবি আঁকিয়ে। ১৫ এপ্রিল সোমবার যখন নটর ডামে ক্যাথেড্রালে আগুনে পুড়ছে, তখন ক্রিস্টিনেকে ফোন দিয়েছিলাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানাল, প্যারিস যেন এই সন্ধ্যায় দুঃখভারাক্রান্তে ভরা বেদনার শহর। প্যারিসবাসী সবাই ঘরে ফিরে টেলিভিশন দেখছে, আর চোখের জলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে আগুন যেন দ্রুত নিভে যায়। ক্রিস্টিনে বলছিল, আমি সেই ছোটবেলা থেকে এই শহরে, বেড়ে ওঠা, শিল্পী হওয়া সবই এই শহরে আর নটর ডামে ক্যাথেড্রালে আর তার পাশেই সিন নদীর তীরে ছবির হাট নিয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি।

শুধু ক্রিস্টিনে মিয়োঁ নয়, প্যারিসবাসী বা লাখো কোটি পর্যটক, যাঁরা প্যারিসের এই প্রাচীন গথিক শিল্পের কারুকার্যখচিত ক্যাথেড্রালেটি পরিদর্শন করছেন বা করেননি, তাঁদের সবার মর্মবেদনার কারণ হয়েছে পুরোনো এই স্থাপত্যতে আগুন। ইউরোপজুড়ে সেদিন ও তার পরের দিন সব সংবাদমাধ্যমের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল নটর ডামে ক্যাথেড্রালের আগুন।

বেশ কিছুদিন থেকেই ৮৫০ বছরের পুরোনো নটর ডামে ক্যাথেড্রালের ছাদ এবং সুউচ্চ চূড়ার সংস্কারকাজ চলছিল। সংস্কারকাজের জন্য চূড়া ও ছাদসংলগ্ন অংশে লোহা, অ্যালুমিনিয়ামের মাচা নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্ভবত সংস্কারাধীন সুউচ্চ চূড়ার কোনো একটি অংশে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। অগ্নিনির্বাপক দলের চার শতাধিক সদস্যের প্রাণান্ত চেষ্টায় রাতভর অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৪ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সরকারি কৌশলীরা জানিয়েছেন, তাঁদের আপাত তদন্তে যা পাওয়া যাচ্ছে তা সম্ভবত দুর্ঘটনা থেকেই এই আগুন। কেউ আগুন লাগিয়েছে, সে আলামত পাওয়া যায়নি।

ঘটনা ঘটে ১৫ এপ্রিল। কথা ছিল ওই দিন সন্ধ্যায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন। ফ্রান্সে চলমান হলুদ ভেস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে তিনি যে নাগরিক সংলাপ করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন সংস্কার নীতিমালা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। সেটা আর তাঁকে এ যাত্রা দিতে হলো না। ভাষণ দেওয়ার এক ঘণ্টা আগেই ঘটল সেই অগ্নিকাণ্ড। অনলে পুড়ল প্যারিসের হৃদয়।

রোমান ক্যাথলিক চার্চ নটর ডামে দ্য প্যারিস বা আওয়ার লেডি অব প্যারিস নির্মিত হয়েছিল ১১৩৬ সাল থেকে ১৩৪৫ সাল পর্যন্ত। নামকরণ করা হয়েছিল গথিক শৈলীতে গড়া ফ্রান্সের প্রাচীন একটি চার্চের নাম থেকে। সিন নদীর তীরে ১৩০ মিটার লম্বা ও ৪৮ মিটার চওড়া ও ৩৫ মিটার উঁচু চার্চটির সামনের দিকে ৬৯ মিটার উঁচু টাওয়ার দুটি প্রাকৃতিক পাথর দ্বারা নির্মিত। চার্চের ভেতর একই সঙ্গে ১০ হাজার লোক প্রার্থনা করতে পারতেন।

১২০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ফ্রান্সে প্রথম গথিক শিল্পের চর্চা শুরু হয়েছিল। এই শিল্পশৈলী অচিরেই ফ্রান্সসহ সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্থাপত্যবিদদের কাছে পাথর, ইস্পাত নানা রঙিন কাচ কেটে গথিক শিল্পীদের অপরূপ রূপশৈলী সব সময় রহস্যময়।

গথিক শিল্পের প্রতি অবহেলা ও অযত্ন দেখে প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো, ১৮২৯ সালে তাঁর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম বা নটরডামের কুঁজো’ লেখা শুরু করেন। সেই সময় প্যারিসসহ ফ্রান্সের অনেক স্থানে গথিক শিল্পশৈলীতে গড়া স্থাপনা সংস্কার বা প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্য সংরক্ষণের বিষয়টি প্রতিপাদ্য হয়েছিল তাঁর উপন্যাসে। গথিক শিল্প নিয়ে এই বিখ্যাত উপন্যাস ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। নানা ঐতিহাসিক কারণে ইউরোপে নটর ডামে ক্যাথেড্রালের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর তা বোঝা যায় সংবাদমাধ্যমে আগুন লাগার পর সপ্তাহব্যাপী নানা সংবাদ প্রকাশ থেকে। জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকা লিখেছে ‘আগুন লাগার ঘটনার পর হাজার হাজার প্যারিসবাসী ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সিন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছিল, যেন ঈশ্বরের ঘরের আগুন দ্রুত নিভে যায়। সেই প্রার্থনার কাতারে ছিল খ্রিষ্টান, মুসলমান, ইহুদি সবাই’।

১৫ এপ্রিল নটর ডামে ক্যাথেড্রালে আগুন লাগার ঘটনার পর প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো ও নটর ডামে ক্যাথেড্রালের মুখপাত্র আন্দ্রে ফিনেট জানিয়েছেন, ক্যাথেড্রালের মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো ও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর ফরাসি সম্রাট নবম লুই বারো শতকে বায়েজেন্টাইন সম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া কথিত ‘ক্রাউন অব থর্নস’ বা খ্রিষ্টান ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় তাঁর মাথায় কণ্টক মুকুটটিও অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা উদ্ধার করেন।

ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এই স্থাপনাটি নির্মাণের পর থেকে অনেকবার সংস্কার করা হয়েছে। তবে তা কখনোই এমন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়নি। নটর ডামে ক্যাথেড্রালের পরিচালক প্যাট্রিক চুভেট জানিয়েছেন, ক্যাথেড্রালের ওপরের অংশের সম্পূর্ণটিই আগুনে পুড়ে গেছে। তবে অগ্নিনির্বাপক দলের কৌশলে ক্যাথেড্রালের সামনের দিকের দুই সৌধ ও চতুর্দিকের কারুকার্যখচিত পাথরের দেয়াল রক্ষা পেয়েছে। তিনি অগ্নিনির্বাপক দলের কৌশল ও জীবন বাজি রেখে জলন্ত ক্যাথেড্রালের ভেতর থেকে নানা মূল্যবান সামগ্রী বের করে আনার জন্য তাঁদের অবদানের প্রশংসা করছেন।

ঘটনার পরের দিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জানিয়েছেন, আগামী ৫ বছরের মধ্যে আবার আমরা নটর ডামে ক্যাথেড্রালের সংস্কারের কাজ আরও সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলব।
নটর ডামে ক্যাথেড্রালের আগুন লাগার পরের দিনই ফ্রান্সের ধনী পরিবারগুলো ক্যাথেড্রালেকে পুনরায় গড়তে কয়েক শ মিলিয়ন ইউরো সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এখন সেই কাতারে শামিল হয়েছেন ধনী–গরিবনির্বিশেষে ধর্ম–বর্ণের মানুষ। তাঁরা অচিরেই প্যারিসের হৃদয় নটর ডামে ক্যাথেড্রালে ফিরে পেতে চান।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]