রেকর্ড কম সময়ে বিচারের আশ্বাস

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা, ঘটনার পটভূমিকা ও পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপ পাঠকের জানা। এগুলোর পুনরুক্তি অনাবশ্যক। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ বিচারপ্রক্রিয়ার সূচনাপর্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, অভিযোগপত্র দায়েরের পর রেকর্ড কম সময়ে এ বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, যেমনটা হয়েছিল রাজন হত্যা মামলায়। আইনমন্ত্রীর এ জোরালো মন্তব্যের জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতে হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সিলেটে বেঁধে ও পিটিয়ে ১৩ বছরের কিশোর রাজনকে হত্যা করা হয়েছিল। এর একজন পলাতক আসামিকে সৌদি আরব থেকে ধরে আনা হয়। দায়রা আদালতের বিচারও শেষ হয় দ্রুততায়। রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় চারজনের। ২০১৭ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট বিভাগ দায়রা জজের আদেশ সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে দণ্ড বহাল রাখেন। বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ায় এ সময়সীমাকে যৌক্তিকই বলব।

একটি হত্যা মামলার বহুমাত্রিক দিক আছে। শুধু আবেগের বশে অস্বাভাবিক দ্রুততায় এসব মামলার বিচার চলে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয় আসামিদের। নুসরাত হত্যার ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। নুসরাত যে মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন, তাঁর অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা তাঁকে শ্লীলতাহানি করেছিলেন। একপর্যায়ে নুসরাত মামলা দায়ের করেন থানায়। অধ্যক্ষের বিশাল প্রভাব। প্রশাসন, পুলিশ, রাজনীতিবিদেরাসহ ক্ষমতাবলয়ের সবাই অবস্থান নেন তাঁর পক্ষে। চাপ দেওয়া হতে থাকে মামলাটি প্রত্যাহারের। এতে তাঁরা রাজি না হওয়ায় অধ্যক্ষের অনুগত কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ৬ এপ্রিল নুসরাতকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে নিয়ে হাত-পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ এপ্রিল মৃত্যু হয় নুসরাতের।

এ ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসেবে অভিযোগ রয়েছে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় উপজেলা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে। তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিআইবি) মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মূল আসামিরা প্রায় সবাই বিচারিক হাকিমের কাছে নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যা-ই হোক, আশা করব মামলার তদন্তকাজ দ্রুত সঠিকভাবে শেষ হবে। ফৌজদারি মামলায় তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এখানে ফাঁকফোকর থাকলে আসামি সুবিধা পেয়ে যান। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রকৃত ঘটনাকে আদালতের সামনে যথেষ্ট প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করতে হবে।

এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে ঘটনাটির শুরুতে স্থানীয়ভাবে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা ছিল। দেশব্যাপী ব্যাপক জনমতের চাপে তা সফল হয়নি। অবশ্য সরকারকে অগ্রণী ভূমিকাতেই দেখা যাচ্ছে। আইনমন্ত্রী অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গেই নজির উল্লেখ করে রেকর্ড কম সময়ে বিচার শেষ করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। যদিও বিচার করেন বিচারকেরা, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আদালতে বিচার চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সতর্ক অবস্থানে থাকলে আসামিপক্ষ অকারণ সময়ক্ষেপণের সুযোগ পায় না। দীর্ঘ সময়ের জন্য মুলতবি হয় না শুনানি। উচ্চ আদালতেও মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় কজ লিস্টে শীর্ষে স্থান করে নেয় এ ধরনের মামলা।

নুসরাত হত্যার ক্ষেত্রে, মোটামুটি নিশ্চিত যে মামলাটি শেষতক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যাবে। আর সব স্তরেই রাষ্ট্রপক্ষের জোরালো ভূমিকায় বিচার ত্বরান্বিত ও ন্যায়ানুগ হয়। নিকট অতীতে অনেক মামলাতেই এটা দেখা গেছে। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে না। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঘটা নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলাটির তদন্ত ও দায়রা আদালতে বিচার যথেষ্ট দ্রুতই হয়। সে মামলার একজন আসামিকে ভারত থেকে আনাও সম্ভব হয়েছে। তিনি ক্ষমতাসীন দলেরই একজন স্থানীয় নেতা। ঘটনার ভয়াবহতা ও আসামিদের পরিচিতি মামলাটিকে একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এ মামলায় দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‍্যাবের বেশ কিছু সদস্য সংশ্লিষ্ট আছেন। ব্যাটালিয়নটির কমান্ডিং অফিসারসহ তিনজন কমিশন্ড অফিসার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। সেই কমান্ডিং অফিসার সদ্য সাবেক এক মন্ত্রীর জামাতা। মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তিতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে। মনে হয়, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষ অতটা তৎপর ছিল না। যা-ই হোক, এর পরবর্তী পর্যায়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করে দণ্ড কার্যকর করতে রাষ্ট্রপক্ষকে তৎপর হতে হবে।

তেমনিভাবে ফেনী শহরেই ২০১৪ সালের ২১ মে প্রকাশ্যে গুলি করে ও আগুন দিয়ে হত্যা করা হয় ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হককে। দায়রা আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচার শেষ হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু আসামিকে। হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটি নিষ্পত্তি করেন ২০১৮ সালের মার্চে। এরপর আর কিছু জানা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ যদি এ ধরনের গুরুতর অপরাধজনিত কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদালতের শেষ স্তর পর্যন্ত জোরালো লড়াই না চালায়, তাহলে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে পারে বিষয়গুলো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দ্রুত নিষ্পত্তি দরকার এসব মামলার।

এরপর প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনা করব তদন্ত স্তরেই থমকে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা প্রসঙ্গ। সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি—দুজনই সাংবাদিক ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা নিজেদের ফ্ল্যাটে খুন হন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক সপ্তাহের মধ্যে খুনিদের শনাক্ত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের নজরেও আনা হয়েছিল বিষয়টি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকেরাও অনেক আন্দোলন করেছেন। এখন মনে হয়, সাগর-রুনি হত্যা মামলার রহস্য আর কখনো উন্মোচিত হবে না। সাক্ষ্য প্রমাণও ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের একজন কর্মীর কন্যা ১৯ বছর বয়সী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়া যায় ২০১৬ সালের মার্চে। দুবার ময়নাতদন্ত করা হয়। মামলাটি সিআইডির কাছে আছে। তদন্তের কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। শুধু কয়েকবার তনুর বাবা-মা ও ভাইকে সিআইডিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এভাবে কি বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদবে?

যা-ই হোক, নুসরাত হত্যা সম্পর্কে সরকার বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ায় আমরা কিছুটা আশ্বস্ত। তবে এ মামলার পূর্বাপর স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও রাজনীতিকদের যে ভূমিকা, সে ক্ষেত্রে এর বিচার ফেনীতে না হওয়াই ভালো। তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে মামলাটি চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা সংগত হবে। এ ধরনের মামলার স্থানান্তরের বিধান ও রেওয়াজ রয়েছে। আমরা চাই, আইনমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত রেকর্ড কম সময়ে নুসরাত হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]