আবার কাঠগড়ায় বিএনপি

২০১৮ সালের নির্বাচন একটি নতুন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে। সেটি বিএনপি ও তাদের জোটের সদস্যদের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করাকে নিয়ে। বাংলাদেশে এর আগের নির্বাচনগুলো নিয়ে অভিযোগ থাকলেও হেরে যাওয়া দলের সাংসদেরা শপথ নেননি, এটি কখনো ঘটেনি। তারপরও ২০১৮ সালের নির্বাচন এতটাই বিতর্কিত ছিল যে এ নির্বাচনের পর বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শপথ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত না নিলে সেটিকে অস্বাভাবিক ভাবা হয়নি। বরং নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে মির্জা ফখরুল বাদে বিএনপির সদস্যরা যেভাবে শেষ মুহূর্তে শপথ নিয়েছেন, সেটিই অস্বাভাবিক বলে মনে করা হচ্ছে এখন।

শপথ গ্রহণের জন্য বিএনপির সমালোচনা হচ্ছে, একে বিএনপির নতুন সংকট বলে দেখছে অনেকে। কিন্তু এর পেছনে যে অস্বাভাবিকতা রয়েছে, তা যে দেশের গণতন্ত্রের সামগ্রিক সংকটেরও বার্তা দিচ্ছে, এটি আমরা অনেকে লক্ষ করছি না। দলের প্রধানকে মুক্ত করা, দলের ভাঙন ঠেকানো বা সরকারের রোষ থেকে নেতা-কর্মীদের বাঁচানো—যে কারণেই বিএনপি শপথ গ্রহণে বাধ্য হোক না কেন, এটি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাজনীতির সুস্থতার ইঙ্গিতবাহী নয়। গণতন্ত্রের গভীরে চেপে বসা এই অসুখের জন্য বিএনপি কতটা দায়ী, নাকি সে নিজেই এর শিকার, এই আলোচনাও আমরা করতে পারিনি অনেক ক্ষেত্রে।

এই বিচ্যুতি বা ব্যর্থতা নতুন নয়। ২০১৪ সালের একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর থেকে আমরা নানান অঘটনকে শুধু বিএনপির সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছি বা এর জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছি। মুদ্রার অপর পিঠের অন্ধকার দেখতে আমরা অনেকে ব্যর্থ হয়েছি বা অনীহ থেকেছি। এই অন্ধকারে শুধু বিএনপি নয়, গোটা দেশই যে আচ্ছন্ন হচ্ছে, সেটিও লক্ষ করতে পারিনি। কিন্তু এটি দেখা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের স্বার্থেই।

২.
দেশের সংকটকে শুধু বিএনপির সংকট হিসেবে দেখার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গত নির্বাচনকালে। রাজনীতির অঙ্গনে এবং গণমাধ্যমে এ সময়ে অনবরত আলোচনা হয়েছে বিএনপির ব্যর্থতা আর ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে। বিএনপি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারল না কেন, মনোনয়ন দিতে গিয়ে কী ভুল করল, নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে কেন ব্যর্থ হলো, নেতৃত্বের কৌশলে কী ভুল ছিল, কর্মসূচিতে কী দুর্বলতা ছিল—এসব নিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছে এ সময়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন তোলা আপাতদৃষ্টিতে ন্যায্য ছিল। এসব যে বিএনপির জন্য বিরাট বিরাট সংকট তৈরি করছে, এমন বিশ্লেষণও অনেকাংশে সঠিক ছিল।

ভুল ছিল অন্যখানে। বিএনপির সংকট, দলটির দুর্দশা, ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হওয়া—এসব কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু দৃষ্টি এড়িয়েছে আরও একটি জরুরি বিষয়। সেটি হচ্ছে, এসব শুধু বিএনপির সংকটকে নির্দেশ করছিল না, এসব ফুটিয়ে তুলছিল দেশের গণতন্ত্রের সংকটকেও। বিএনপির প্রায় প্রতিটি ব্যর্থতা ছিল আরও বড় একটি সংকটের সিম্পটম বা লক্ষণ। সেটি হচ্ছে দেশের মানুষের অধিকারহীনতা, এই অধিকার উপেক্ষা করার মতো একটি শক্তির উন্মেষ।

আমরা গত নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির গভীরে গেলে বিষয়টি বুঝতে পারব। গত নির্বাচনে বিএনপির প্রতি মূল অভিযোগ ছিল, নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাতে দলটির সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা। অন্যদিকে সরকারি দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, গায়েবি মামলা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা এবং আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে নির্বাচনকে কলুষিত করার।

দুটো অভিযোগের কোনটি কতটুকু সত্যি, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবে দুটো অভিযোগের পক্ষেই সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আলামত রয়েছে। বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন ছিল দলের ভেতরে এবং জোটেও (যেমন: জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে), দলে সমন্বয়হীনতা ছিল হাস্যকর পর্যায়ে (যেমন মওদুদের ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপ)। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আলামত ছিল অবিশ্বাস্য ভোটের অঙ্ক, টিআইবির গবেষণা, বিবিসির মতো গণমাধ্যমের বিভিন্ন ফুটেজ, এমনকি সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনী জোটসঙ্গীর বক্তব্যেও (নির্বাচনের আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি, নির্বাচনের পরে দুই জাসদ ইত্যাদি)।

দুটো অভিযোগই যদি আমরা সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে তা বিএনপির সংকটকে যতটা ফুটিয়ে তোলে, তার চেয়ে বেশি সরকারি দলের সংকটকে ফুটিয়ে তোলে, সবচেয়ে বেশি ফুটিয়ে তোলে দেশের মানুষের সংকটকে।

প্রথম সংকট মূলত একটি দলের। দ্বিতীয় সংকটটি রাষ্ট্রব্যবস্থার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি দলের। একটি দেশে যদি ভয়াবহ কলুষিত ও কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন করা সম্ভব হয়, তাহলে তার বলি হয় দেশের প্রতিটি মানুষ। কারণ, দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর (রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ, সংসদ) ব্যর্থতার কারণে পাঁচ বছর পরপর মাত্র একবারই তারা সুযোগ পায় সরকারের বিচার করার, সরকারের প্রতি তার ক্ষোভ ও আপত্তির প্রতিকার আদায়ের। এই সুযোগই যদি আর না থাকে, তাহলে শাসকদের অত্যাচারী আর অনাচারী হয়ে ওঠার পথে আর কোনো বাধা অবশিষ্ট থাকে না।

৩.
বিএনপির সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের দুর্বলতার দায় দলটির নিজের। কিন্তু তার কিছু ব্যর্থতার রূপকার দলটি নয়, বরং দলটি এর শিকার। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমান ঠিকভাবে দল পরিচালনা করতে পারেননি, বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করতে পারেনি, চরম প্রতিকূল পরিবেশে কার্যকরী রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে পারেনি—এসব বিএনপির নিজস্ব ভুল। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিকালে দলটি যে বড় ধরনের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (যেমন: ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়া, ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্ধারিত সভা বাতিল ইত্যাদি), তার দায়ও শুধু দলটির নিজের। কিন্তু যে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থায় খালেদা জিয়া অন্তরীণ হয়ে আছেন, দলটি যেভাবে সভা–সমাবেশ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে, যেভাবে পুলিশি নির্যাতন ও ঢালাও গায়েবি মামলার শিকার হয়েছে, সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে—এসব বিষয় বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সংকটকে নির্দেশ করে। এসব সংকটের রূপকার বিএনপি নয়, বরং সরকার ও শাসক দল।

সভা–সমাবেশ বা প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হামলাকে শুধু বিএনপির অতীত আচরণের প্রতি প্রতিশোধমূলক বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে দেখারও উপায় নেই। কারণ, এসব গুরুতর সংকটের বলি হয়েছে শুধু বিএনপি নয়, বাম মোর্চা থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—সবাই। বাক্স্বাধীনতার চর্চার অধিকার খর্বিত হয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত সবার। ১৯৯০ সালের পর থেকে জনগণের মৌলিক অধিকারের ওপর এতটা খড়্গহস্ত হতে আর কোনো সরকারকে দেখা যায়নি। কখনো সভা–সমাবেশ, মিছিল করার অধিকার সরকারি দল এতটা একতরফাভাবে ভোগ করেনি, কখনো এত গায়েবি মামলা হয়নি, কখনো বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্য এত বেশি মানুষকে মামলার শিকার হতে হয়নি, কখনো সরকারি দলের সন্ত্রাস এতটা মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠেনি। এসব বিবেচনায় গত প্রায় এক দশকে যে প্রক্রিয়ায় দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত করে একটি অসীম ক্ষমতাশালী শাসনব্যবস্থা দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা–ই আমাদের প্রকৃত সংকট। এই সংকট মোচন করতে শুধু বিএনপি নয়, বাকি সবাই ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট শুধু বিএনপি নয়, বাকি সবার মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আশা–আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করেছে।

বিএনপির দুর্দশায় হতাশ বা আনন্দময় আলাপ করা যেতেই পারে। কিন্তু কারা কীভাবে দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকট তৈরি করেছে বা একে গভীরতর করেছে, কীভাবে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব—এসব আলোচনাই সবচেয়ে জরুরি এখন। এই বোধটা হারিয়ে গেলে মানসিকভাবে এক অদ্ভুত বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিণত হব আমরা।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক