অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ বনাম অন্ধত্বের কাল

চট্টগ্রামের অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
চট্টগ্রামের অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের এথেন্সে সক্রেটিস মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যুবসমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগ ওঠানো হয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিজের মতাদর্শকে প্রকাশ্যে মিথ্যা ঘোষণাও তিনি করেননি, যেটি করলে মৃত্যুদণ্ড রহিত হতে পারত। বরং তিনি স্বেচ্ছায় হেমলক পান করেছিলেন। চট্টগ্রামের অধ্যাপক অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ সক্রেটিস নন; তিনি ইংরেজি সাহিত্যের একজন আন্তরিক অধ্যাপক মাত্র, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ চার দশক শিক্ষকতা করে সম্প্রতি অবসরে গিয়েছেন। বিভাগ থেকে তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের একজন বলেছিলেন, ‘আজ থেকে করিডরে আপন মনে হেঁটে যেতে আর এমন একটা মানুষকে দেখব না, যিনি তাঁর ক্লাস শুরুর আগেই দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন, লেকচারে আমাদের হাসাতেন, কাঁদাতেন; যাঁর ক্লাস করলে মনে হতো সারা বিশ্ব থেকে জ্ঞান সেচে তিনি আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন।’ কোলরিজের কবিতা এবং ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটক পড়াতেন বলে ছেলেমেয়েরা আড়ালে দুষ্টুমি করে তাঁকে কখনো ডাকতেন এনশ্যেন্ট ম্যারিনার, কখনো ডক্টর ফাউস্টাস। এমিলি ডিকিনসনের ওপর পিএইচডি করার কারণে ডিকিনসনের মৃত্যুপরবর্তী প্রেমিকের উপাধিও তাঁর কপালে জুটেছিল। তাঁর পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত স্বনামধন্য অধ্যাপক নিয়াজ জামান আমাকে অনেকবার বলেছেন, ‘মাসুদের মতো মেটিক্যুলাস রিসার্চার আমার শিক্ষকজীবনে আমি আর পাইনি।’ এখানে বলে রাখি, তাঁর পিএইচডির সন্দর্ভটি দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে। অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের আরও দুটি পরিচয় হলো তিনি একজন কবি ও অনুবাদক। ‘লিসনিং টু মি’ শিরোনামে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন আবুল হাসানের কবিতাকে।

অবসরের পর অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন চট্টগ্রামেরই ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি) নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ঢেঁকি যেখানে ধান ভানতে গিয়েছিল, সেটি কোনো স্বর্গ ছিল না। সেখানকার ইংরেজি বিভাগের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন, তাতে করে বহু শত্রু জুটে গিয়েছিল তাঁর। নিয়ম করে ক্লাস নেওয়া, সিলেবাস শেষ করা, বাজারের নোট বই না পড়িয়ে বা অল্প কিছু প্রশ্ন ‘সাজেশন’ দেওয়ার বদলে সম্পূর্ণ পাঠ্যবই পড়ানোর যেসব বাধ্যবাধকতা এই নতুন উপদেষ্টা জারি করেছিলেন, তাতে শিক্ষকদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হন। তা ছাড়া, নির্দিষ্টসংখ্যক ক্লাসে উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার নিয়মটিও কোনো কোনো শিক্ষার্থীর জন্য অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। পরীক্ষার ঠিক আগে তাঁরা নিশ্চিত হয়ে যান, নিয়মনিষ্ঠ অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ থাকলে তাঁদের পরীক্ষা দেওয়া হবে না। ক্ষুব্ধ শিক্ষক ও ছাত্ররা মিলে তাই অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে তাড়ানোর ষড়যন্ত্র রচনা করেন। কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাঁর বিরুদ্ধে তিন পৃষ্ঠার চৌদ্দটি অভিযোগ করেন। অভিযোগগুলোর মূল বক্তব্য এই যে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ ক্লাসে অপ্রাসঙ্গিকভাবে যৌনতাবিষয়ক আলোচনা করে তাঁদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, তিনি মা-ছেলে এবং বাবা-মেয়ের মধ্যে যৌনতার উল্লেখ তাঁর ক্লাসে করেছেন। স্পষ্টতই এই শিক্ষার্থীরা কখনোই সফোক্লিসের ‘ইডিপাস রেক্স’, শেক্‌সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’, ডি এইচ লরেন্সের ‘সন্স অ্যান্ড লাভারস’ বা নবোকভের ‘লোলিটা’ পড়ে দেখা দূরে থাক, এগুলোর নামও শোনেননি। পড়লে তাঁরা জানতেন, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাহিত্যকর্মগুলোর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ওই ধরনের ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা শিক্ষক হিসেবে তাঁকে করতেই হতো। সারা পৃথিবীর ইংরেজি সাহিত্য বিভাগগুলোয় এগুলো পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা আরও বলেছেন, টি এস এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ পড়াতে গিয়ে তিনি মেয়েদের ঋতু ও যৌনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তাঁদের বিবাহপূর্ববর্তী যৌনতায় উৎসাহিত করার জন্য। সাহিত্যের শিক্ষার্থীমাত্রই জানার কথা, এই কবিতায় এলিয়ট ফার্টিলিটি মিথ বা উর্বরতা পুরাণের ব্যবহার করেছেন এবং যৌনতার বিভিন্ন দিকের আলোচনা এতে প্রাসঙ্গিক। এই শিক্ষার্থীরা তাহলে কি চাইছে যে বিশ্বসাহিত্যের সেরা কীর্তিগুলো ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হোক?

ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এসব হাস্যকর অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই যখন নাকচ করে দেয়, তখন তাঁরা দ্বারস্থ হন একজন মন্ত্রীর। মন্ত্রী মহোদয় আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজি সাহিত্যের সেরা শিক্ষকদের না বলে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেন পুলিশকে। পুলিশ করবে সাহিত্য ও নীতি-নৈতিকতার বিচার? ফলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের শ্রেণিকক্ষের আচরণ তদন্তাধীন রয়েছে এবং তিনি জেরার পর জেরার সম্মুখীন হচ্ছেন। যেখানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের নানা অভিযোগ বিচারের আওতায় আনতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ এবং তার ভিত্তিতে নানা রকমের হেনস্তার যে আয়োজন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা সত্যিই লজ্জাজনক। চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে যাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আসেনি, যিনি সারা জীবন শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, তাঁর জন্য এটা যথার্থ পুরস্কারই বটে!

বিষয়টি আরও জঘন্য আকার ধারণ করে যখন কিছু স্থানীয় সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজপোর্টাল ঘটনাটি নিয়ে রসালো খবর পরিবেশন করতে শুরু করে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের মন্তব্য না নিয়েই। মিডিয়া ট্রায়ালের হেমলক যে সক্রেটিসের মতোই তিনি হাসিমুখে পান করছেন, তা আমি বুঝতে পারি যখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে বলেন, ‘তোমরা আমার সন্তান। যে অভিযোগ তোমরা করেছ তা আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও তোমাদের প্রতি আমার একবিন্দুও ক্ষোভ নেই।’ অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীরা তাঁর অসম্মানের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন। তাঁদের আয়োজিত মানববন্ধনে সর্বস্তরের জনতার ঢল নামলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ তাঁদের উদ্দেশে লেখেন, ‘তোমরা তোমাদের লেখাপড়া ও কাজ ফেলে যেভাবে আমার অপমানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছ নিজেদের মূল্যবান সময় খরচ করে, তাতে আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছে। ...আমার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তোমরা যদি ষড়যন্ত্রকারীদের চক্ষুশূল হও, তোমাদের কোনো রকম ক্ষতি হয়, আমি নিজেকে কোনো দিন ক্ষমা করতে পারব না।’

এই হচ্ছেন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বা গবেষণাগারে কী আলোচনা করতে পারবেন, তা কে নির্ধারণ করে দেবে বা আদৌ কি কারও নির্ধারণ করার এখতিয়ার আছে? পাঠদান বা গবেষণার বিষয়বস্তুর জন্য কি শিক্ষককে কারও অনুমতি নিতে হবে? জ্ঞানচর্চার কি কোনো সীমা থাকতে পারে বিদ্যায়তনে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে যে আজ পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে, তার পরিণতি কী হতে পারে, তা কি আমরা ভেবে দেখছি? তিনি শ্রেণিকক্ষে যৌনতাবিষয়ক কথা বলেন কি না, কেন বলেন, না বললে কী হয়—এ ধরনের জেরার কী সুদূরপ্রসারী প্রভাব মুক্তচিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর পড়বে, তা আমাদের গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। সবশেষে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের কাছে এই দেশের মানুষের হয়ে আমি করজোড়ে ক্ষমা চাই। তিনি বেঁচে আছেন অন্যদের সময়ে।

লেখক: পোস্টডক্টরাল গবেষক, স্টেলেনবশ ইউনিভার্সিটি, সাউথ আফ্রিকা।