প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা

ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণীকুলের আবাসস্থল যখন বাসের উপযোগী থাকে না, তখন অনেক প্রাণী নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে লোকালয়ের কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু তাদের এই বিপদের সময় আশ্রয়স্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, কেননা মানুষ তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। যেসব প্রাণীর মাংস মানুষের খাওয়ার যোগ্য, সেগুলো শিকার করার পেছনে একটা যুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব প্রাণী মানুষ খায় না, যেগুলোর চামড়া ও শরীরের কোনো অংশই মানুষ ব্যবহার করে না, তাদের হত্যা করার পেছনে কোনো যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের এই যুক্তিহীন আচরণের ব্যাখ্যা হতে পারে তার আদিম নিষ্ঠুরতা।

দুই দিন আগে ফণী নামে যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, তার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিতে বন্য প্রাণীকুলের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকালয়ের কাছে চলে আসা অনেক বন্য প্রাণী মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে। সিলেট সদর উপজেলার বাইশ টিলা এলাকায় একটি শিয়াল হত্যা করে তার ঝুলন্ত মরদেহ ঘিরে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক ও কয়েকজন কিশোরের উল্লাস প্রকাশের ছবি ছাপা হয়েছে। এ ধরনের অকারণ নিষ্ঠুরতার ঘটনা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েই ঘটে, এমন নয়। এ দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষ স্বাভাবিক সময়েও অকারণে প্রাণী হত্যা করে, প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতা চালায়। এমন খবর কালেভদ্রে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

প্রাণী হত্যা করা ও তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলের স্বাভাবিক নিরুপদ্রব পরিবেশ নষ্ট করার ফলে যে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয় এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়, এ বিষয়ে আমাদের সমাজে জনসচেতনতার প্রকট অভাব রয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশে দুটি আইন আছে। একটি হলো ২০১২ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন। আইনটি প্রথম গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালে; ২০১২ সালে সর্বশেষ সংশোধিত আইনটিতে বন্য প্রাণী হত্যার দায়ে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। অন্য আইনটি ১৯২০ সালের পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইন। এ আইনেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু দুটি আইনই ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে; বস্তুত দেশের অধিকাংশ মানুষেরই এ দুটি আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইনের অধীনে এ পর্যন্ত মাত্র একটি মামলার বিচারে আসামির শাস্তি হয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে দুটি মা কুকুর ও তাদের ১৪টি ছানাকে বস্তায় পুরে মাটিচাপা দিয়ে হত্যার দায়ে ঢাকা মহানগর আদালতের হাকিম আহসান হাবীব ছিদ্দিক মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে ছয় মাস কারাদণ্ড ও ২০০ টাকা জরিমানা করেছিলেন। সম্প্রতি আইনটি হালনাগাদ করে সংশোধনীর একটি বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে।

আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি প্রাণীকুলের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।