নারী: 'শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে'

প্রাণিজগতের স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের নিয়ম হওয়ার কথা জঙ্গলের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্র কর্তৃক বেঁধে দেওয়া আইনকানুনের ভিত্তিতে সমাজ-সংসার পরিচালিত হয়। একটা দেশ বা সমাজে অপরাধভেদে আইনভঙ্গের শাস্তির বিধান করে থাকে। শাস্তির বিধান যেখানে বলবৎ, ধরে নেওয়া যায়, সেখানে আইনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার ঘাটতি থাকলেও শাস্তির ভয়ভীতি জনগণকে আইন মানতে উৎসাহিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্য করে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি কঠোর ও আপসহীন, সে দেশে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির প্রদর্শনী চলার কথা না। অন্যদিকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা যে সমাজে বেশি, সে সমাজের জনগণের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কথা নয়।

পশুরাজ্যে শিকারের রেওয়াজ আছে, কমজোরি প্রাণীকে ধর্ষণের নজির আছে কি না জানা নেই। অথচ শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্ষণ-নির্যাতনের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশে দেশে নারীর উত্তরণ ঘটলেও সহিংসতার কৃষ্ণগহ্বর থেকে আজও তার মুক্তি ঘটেনি। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের মেয়েরাও অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশগুলো থেকে এগিয়ে আছে। ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুসারে এ উচ্ছ্বাস হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিকভাবে নারীর প্রতি দৃষ্টি রাখলে উচ্ছ্বাসের পলেস্তারা খসে গিয়ে হতাশা ভর করে। ক্ষমতায়নে নারীর এ অর্জনের সার্বিক ফলাফল অর্থহীন মনে হয়, যখন দেশের নারীসমাজের একটা বিরাট অংশের ওপর সহিংসতার মাত্রা কমার বদলে আরও বাড়ে।

২০১৭ সালের অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার। ৫৭ শতাংশ নারীর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের অভিযোগের গুরুত্ব দেয় না। ৬৫ শতাংশ নারী মনে করেন, সহিংসতার জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য উল্টো নারীদেরই দায়ী করার মানসিকতা ধারণ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশ লোক। গবেষণায় দেখানো হয়, ৪৯ শতাংশ নারী গণপরিবহনে নিজেদের অনিরাপদ মনে করেন। স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সরকারি সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ৪৮ শতাংশ নারী নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবেন। নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ১০টি দেশের তথ্য প্রকাশ করে অ্যাকশনএইড। গবেষণার জরিপে ৩৯ দশমিক ৩২ পয়েন্ট নিয়ে সি গ্রেডে ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের এই অবস্থান। গবেষণায় পাঁচটি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হলো নারীর প্রতি সহিংসতা, সহিংসতা মোকাবিলায় আইনগত সুযোগ, নারীবান্ধব বাজেট, নারীবান্ধব নগর ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা। এগুলোর মধ্যে নারীবান্ধব নগর ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য।

এ-ই যখন শহরাঞ্চলের নারীদের দশা, গ্রামীণ সমাজে নারীদের অবস্থান কতটা করুণ, সেটা সহজেই অনুমেয়। মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদের তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে দেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৯৪২, ধর্ষণের পর হত্যা ৬৩ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার ১৪৬ জন এবং যৌতুকের জন্য হত্যা ১০২ জন।

২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন দুজন। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ২১ নারীর ওপর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আসকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এ তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ৪৬। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৭ নারী। এর কারণে আত্মহত্যা করেছেন একজন, প্রতিবাদ করায় নিহত হয়েছেন দুজন পুরুষ। এ ছাড়া হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৩২ নারী ও পুরুষ।

দৈনিক পত্রপত্রিকার খবরে সংঘটিত সহিংসতার এমন সব নিষ্ঠুর বিবরণ উঠে আসে, যা আমাদের সামাজিক সুস্থতা এবং নারীর নিরাপত্তা দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। পশুরাজ্যের বাসিন্দা হলে লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করলেও চলে যেত। কিন্তু মানুষ হওয়ার দায় তো এড়ানো যায় না! আমরা লজ্জিত হই, ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হই।

অতি সম্প্রতি নুসরাতের ঘটনাটি সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবতা চিনিয়েছে। নুসরাত বাঁচতে চেয়েও পারেননি। ঘটনাটি ঘটে এমন একটি জায়গায়, যেখানে নুসরাতের সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিল। নির্জন বাস-ট্রাক-পার্ক নয়, ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-পুলিশে ভরপুর একটি পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রের দালানের ছাদে, তাঁরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তাঁরই মতো শিক্ষার্থীর মাধ্যমে কেরোসিন দিয়ে তাঁকে পোড়ানো হয়।

এমন জঘন্য ঘটনায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের যূথবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ার কথা ছিল, যা এ ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ঘটনাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যতটা তোলপাড় হয়েছে, বাস্তবে তার অল্পই ঘটেছে। ঘটনাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি গোচর হওয়ায় গুরুত্ব পায়। নইলে আর দশটা নির্যাতনের কাহিনির সঙ্গে এটিও চাপা পড়ত।

নুসরাতের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার যখন তোড়জোড় চলছে, তখন আরও আরও ধর্ষণ-পরবর্তী খুনের ঘটনা ঘটে এবং সেগুলো তেমন গুরুত্ব পেতে ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া ধর্ষণের পেছনে ভূমিকা রাখছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং অপরাধের রাজনৈতিকীকরণ। অপরাধী যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে, তাহলে সে বিচারের হাত থেকে বেঁচে যায়। যেকোনো অপরাধীই অপরাধ করার পর কোনো না কোনো ক্ষমতাবানের আশ্রয় লাভ করে। ধর্ষণের অপরাধটা হলো সবচেয়ে সহজ অপরাধের একটি, যাতে আক্রান্ত নারী অনেক সময় সামাজিকভাবে নিগ্রহের শিকার হওয়ার ভয়ে প্রকাশ করতে চান না। এ কারণে প্রকাশিত ধর্ষণের চেয়ে অপ্রকাশিত ধর্ষণের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেশি। আরেকটি কারণ হলো এ দেশের আইন ও বিচারপ্রক্রিয়া নারীটিকে আরও কয়েকবার সামাজিকভাবে ধর্ষণ করে সপরিবারে।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের সংবাদ। একটা ঘটনার জের শেষ না হতেই আরেকটি ঘটনা। একটি ঘটনা যেন আরেকটি ঘটনাকে উৎসাহিত করে। পুরোনো ঘটনাকে চাপা দিয়ে জন্ম নেয় নতুন ঘটনা। ধর্ষকেরা সব এই সমাজেরই সদস্য। পরিবহনশ্রমিক থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, এমনকি জন্মদাতা বাবা পর্যন্ত, যেকেউ যেকোনো সময় মুখোশ খুলে ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আরও ভয়ানক ব্যাপার হলো সেই ধর্ষকেরও সমর্থক আছে। ফেসবুকে ধর্ষণের ঘটনার আলোচনায় অনেক ভদ্রবেশী পুরুষের মন্তব্য পড়ে আশঙ্কা জাগে, জগতের বড় অংশের পুরুষই সম্ভাব্য ধর্ষক কি না, যারা ধর্ষকের দোষ না দেখে কোনো না কোনোভাবে নারীর খুঁত বের করে দোষী সাব্যস্ত করে। ধর্ষণের শিকার নারীর একমাত্র অপরাধ তার শরীর। যতই রেখে ঢেকে রাখুক, চামড়ায় মোড়ানো একটি নারী শরীর তার খাদকের আক্রমণের জন্য যথেষ্ট অজুহাত। যেকোনো বয়সে নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু নারীর শরীরকেই তার নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় কি? ধর্ষণ একটা পুরুষালি মানসিকতা, যার শিকার যেকোনো শরীরই হতে পারে—শিশু থেকে বৃদ্ধা কিংবা মানুষ অথবা পশু! শিকারির চোখ যে সমাজে সর্বক্ষণ উদ্যত, সেখানে নারী কোথাও নিরাপদ নয়। কোথাও না!

নাহার তৃণা: গল্পকার।