সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির লড়াই চলছে

স্পেনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কট্টর ডানপন্থীরা নারীবাদবিরোধী বিক্ষোভ করেন
স্পেনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কট্টর ডানপন্থীরা নারীবাদবিরোধী বিক্ষোভ করেন

আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে আঙ্কারায়, কিছু অংশ মাদ্রিদে। ১৯৮০–এর দশকের শুরুতে স্পেন ও তুরস্কের মধ্যে যাতায়াতের অভিজ্ঞতাটা ছিল ভারি অদ্ভুত। বহু বছরের একনায়কত্ব শেষে স্পেন সরাসরি গণতন্ত্রের পথে উঠে আসে। অন্যদিকে তুরস্ক এখনো গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরশাসনে আটকে আছে। এই দুটি দেশই ইউরোপের কিনারায় পড়েছে।

আমি শৈশবে যে স্পেনকে পেয়েছিলাম, সেই স্পেন ছিল অনেক বেশি অতিথিবৎসল, আন্তরিক ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। প্রাচীনপন্থী অল্প কিছু লোক ছাড়া স্পেনের বাকি সবাই গণতন্ত্রকামী ছিল। আমি আমার জন্মভূমিকে যে রকম দেখতে চেয়েছিলাম, ঠিক তেমন পরিবেশই ছিল সেখানে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এমন একটি দৃশ্য চোখে পড়ল, যা দেখে আমার সেই ভাবনা প্রথমবারের মতো বাড়ি খেল। দেখলাম রাস্তার পাশের দেয়ালের গা ভরে ফেলা হয়েছে পোস্টারে। সেই পোস্টারে ডাস্টবিনে ফেলে রাখা মৃত নবজাতকের বীভৎস ছবি। একটি অতিরক্ষণশীল ক্যাথলিক গ্রুপ পোস্টারগুলো লাগিয়েছিল। পোস্টারে লেখা ছিল, পারিবারিক মূল্যবোধ আক্রান্ত হয়েছে। বন্ধনমুক্তির নামে নারীবাদীরা গর্ভপাতের মতো নিকৃষ্ট কাজ করছে।

পুরুষতান্ত্রিক একটি নেতিবাচক প্রচারণা তখন থেকেই ছিল। তখন থেকেই সংস্কৃতির যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল। সেই যুদ্ধ তখন ভেতরে-ভেতরে চলছিল। এখন তা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। স্পেনের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। ১৯৭৮ সালের পর এই প্রথম সেখানে কট্টর ডানপন্থীদের বড় ধরনের উত্থান দেখা গেছে। উগ্র ডানপন্থী দল ভোক্স পার্টি ১০.২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ২০১৩ সালে গঠিত এই দলটি স্পেনের দ্রুততম বর্ধনশীল আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এত দিন বলে এসেছেন, গণতান্ত্রিক উন্মেষ ঘটায় ডানপন্থীরা ইউরোপে আর কোনো দিন মাথাচাড়া দিতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের কথা ভুল প্রতিপন্ন হতে বসেছে। ভোক্স পার্টি জনতুষ্টিবাদী অবস্থান নিয়ে যেসব বিষয় সামনে এনেছে তা হলো, অভিবাসনবিরোধিতা, বৈচিত্র্য বিরোধিতা, সমলিঙ্গের বিয়ের বিরোধিতা এবং সমকামীদের অধিকারের বিরোধিতা। এর মাধ্যমে তারা বিশ্বকে একটি কাল্পনিক ও পৌরাণিক ‘স্বর্ণযুগে’ নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সম্প্রতি কাতালানে যে দাঙ্গা হয়েছে, তার পেছনে বড় উসকানি দিয়েছে এই ভোক্স পার্টি।

জনতুষ্টিবাদী জাতীয়তাবাদীরা কল্পিত শত্রু মোকাবিলা পছন্দ করে। ভোক্স পার্টিও এর ব্যতিক্রম নয়। এই দলের আদর্শের কেন্দ্রে রয়েছে নারীবিদ্বেষ। তারা সব সময়ই ফেমিনিস্ট বা নারীবাদীদের ‘নাজি’ বা নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা করে। ফেমিনিস্টদের তারা ব্যঙ্গ করে ‘ফেমিনাজি’ বলে। তাদের ভাষ্য হলো, ‘ফেমিনাজিদের’ হাতে পুরুষেরা চরমভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। তারা মনে করে, বিদ্যমান নারীবাদ সামাজিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক বন্ধনের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরুষতান্ত্রিকতা আছে বলে তারা বিশ্বাস করে না।

স্পেনে এই নারীবিদ্বেষ আমদানি হয়েছে তুরস্ক থেকে। তুরস্কে ক্ষমতাসীন একেপি পার্টি ‘জেন্ডার মিনিস্ট্রি’কে ‘মিনিস্ট্রি অব ফ্যামিলি’ বা পরিবার মন্ত্রণালয়ে রূপান্তর করেছে। স্পেনেও একইভাবে জেন্ডার মিনিস্ট্রিকে ভোক্স পার্টি পরিবার মন্ত্রণালয় বানাতে চায়। এই নামবদল গভীর তাৎপর্য বহন করে। এর মাধ্যমে সবার দৃষ্টি লিঙ্গবৈষম্য থেকে সরিয়ে এনে ‘ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধের’ ওপর নিবদ্ধ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভোক্স পার্টির মুখপাত্র ফ্রান্সেসকো সেরানো বলেছেন, ইউরোপে পুরুষদের ওপর ‘গণহত্যা’ চালানো হচ্ছে। এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার হার অনেক বেশি—এমন একটি সমীক্ষা হাজির করেছেন।

সম্প্রতি ইতালিতে কট্টর ডানপন্থীদের আয়োজনে ‘পারিবারিক অধিকার সম্মেলন’ নামের একটি সম্মেলন হয়েছে। সেখানে ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তিও সালভিনি প্রধান বক্তা ছিলেন। সেখানে তিনি নারীবাদী ও অভিবাসীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

পোল্যান্ডে ডানপন্থী ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সদস্যরা দেশকে ‘সমকামীমুক্ত’ করার আন্দোলন চালাচ্ছে। এই দলের নেতা কাচিজনস্কি বলেছেন, সমকামীরা শুধু পোল্যান্ডের জন্য হুমকি নয়, বরং তারা গোটা ইউরোপ ও খ্রিষ্টানমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার জন্য বিরাট হুমকি। হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ওরবান জন্মহার বাড়ানোর জন্য সন্তান নেওয়ায় নাগরিকদের বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জেন্ডার স্টাডিজ বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছেন। তুরস্কে এরদোয়ান গর্ভপাতকে গণহত্যার চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দেশবাসীকে বেশি বেশি সন্তান নিতে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন।

এই রক্ষণশীলরা এক গভীর যুদ্ধোন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমেরিকান বুদ্ধিজীবী হান্টিংটন মনে করছেন, আধুনিক বিশ্ব ‘সভ্যতার লড়াইয়ের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। যে লড়াই চলছে তা আসলে সংস্কৃতির লড়াই। এই লড়াই প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে এমন এক বিভাজন টেনে দিচ্ছে, যার রেশ থাকবে বহুকাল। এর জন্য গোটা বিশ্বকেই খেসারত দিতে হবে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
এলিফ শাফাক: স্পেনের ঔপন্যাসিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী