দলে-জোটে টানাটানি

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা টানাপোড়েন, অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সংসদে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে গেছে। অন্যদিকে, এরশাদের উত্তরাধিকার কে হবেন, তা নিয়ে ভাই-ভাবির লড়াইও জমে উঠেছে। জাতীয় পার্টির সভাপতি এরশাদ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। তিনি ছোট ভাই জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছেন। এ নিয়ে এরশাদের স্ত্রী রওশনের অনুসারীরা ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপির সাংসদেরা বলেছিলেন, শপথ নেবেন না, সংসদেও যাবেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। দলের পাঁচজন সাংসদ শপথ নিয়েছেন। সংসদেও গিয়েছেন। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ছয়জন প্রার্থী জয়ী হন, যাঁদের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ছিলেন। তিনি শপথ নেননি। তাঁর ব্যাখ্যাটা এ রকম: দলের সিদ্ধান্তে চার সাংসদ (দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাহিদুর রহমান আগেই শপথ নিয়েছিলেন) শপথ নিয়েছেন এবং দলের সিদ্ধান্তেই তিনি (মির্জা ফখরুল) শপথ নেননি। এটি তাঁদের কৌশল। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। আর দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত। ফলে, বিএনপি এখন অনেকটা কান্ডারিবিহীন। আর জাতীয় পার্টি অন্তর্দ্বন্দ্বে নাকাল।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগে সমস্যা না থাকলেও সরকারের সামনে অনেক সমস্যা। নির্বাচনের পর দেশে একটার পর একটা সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সরকারকে পুরোনো সমস্যার পাশাপাশি অনেক নতুন সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে অনেক স্থানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে রাসায়নিক কারখানায় আগুন লেগে ৭১ জন মানুষ মারা যায়। চকবাজারের ট্র্যাজেডির পর জানা গেল, নিমতলীর ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও সরকার নির্বিকার ছিল। অথচ তারা বলেছিল, পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু সরানো হয়নি। চকবাজারের রেশ না কাটতেই বনানীতে ঘটল আরেক ট্র্যাজেডি, যাতে ২৬ জন মানুষ মারা যায়।

আওয়ামী লীগের অস্বস্তির কারণ বিরোধী দল নয়, অভ্যন্তরীণ বিরোধ। ৭০ বছর বয়সী দলটি নিজেকে যতই সুশৃঙ্খল বলে দাবি করুক না কেন, নির্বাচন এলেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মন্ত্রী-বনাম সাংসদ; সাংসদ বনাম-উপজেলা চেয়ারম্যান। সাম্প্রতিক একতরফা উপজেলা নির্বাচনেও যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটেছে, তা আওয়ামী লীগের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে। অনেক মন্ত্রী-সাংসদ বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন।

এ নিয়ে দলের হাইকমান্ড সতর্ক করলেও কোনো লাভ হয়নি।

নির্বাচনে একটি দল কত বেশি আসনে জয়ী হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কতটা কাবু করতে পারল, তা দিয়ে কখনো সরকারের সাফল্য মাপা যায় না। বরং যে দল যত বেশি আসনে জয়ী হয়, সেই দলের বিপদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি থাকে। নেতা-কর্মীরা দুর্বিনীত হয়ে ওঠেন। নেতৃত্ব সামাল দিতে পারে না। স্বাধীনতার পর এবং নিকট অতীতে এর অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু কথায় বলে, ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা’। আওয়ামী লীগ নেতারা বুঝতে অপারগ যে রাজনীতির এই ভারসাম্যহীনতা শুধু গণতন্ত্র বা আইনের শাসন নয়, ক্ষমতাসীন দলটির জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকে। আমাদের দেশে ক্ষমতা বরাবরই এককেন্দ্রিক।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার সাত থেকে আটে উঠেছে, মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটিই বেড়েছে। সরকার এসব সাফল্য হিসেবে দাবি করতে পারে (যদিও এর মূল যে নায়ক কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও দেশীয় শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক; তাঁদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক)। কিন্তু এর পাশাপাশি বড় দাগে সরকারের ব্যর্থতাও কম নয়। গত ১০ বছরে এমন কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি, যাতে বিরোধীরা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে, সংবাদমাধ্যম নির্ভয়ে কথা বলতে পারে। নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে ফারাকটুকু ছিল, তা-ও ঘুচে গেছে।

ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগ যে সুশাসন, অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং সাম্প্রদায়িক বৈষম্য বিলোপের ওয়াদা করেছিল, তা পূরণ হয়নি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়নি। গত ১০ বছরেও আওয়ামী লীগ শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বরং মানুষ বলতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়, ঋণখেলাপিরা হক না-হক অনেক সুবিধা পেয়ে যায়। একদা আওয়ামী লীগ গরিবের দল হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন ধনীরাই আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যবসায়ী নেতার সংখ্যা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগে বেশি। নতুন অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেয়ারবাজার নিয়ে না খেলার জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কারা খেলছেন, সে কথাটি স্পষ্ট করেননি। খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সদুপদেশ দিলে শেয়ারবাজারের ধস ঠেকানো যাবে না।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক প্রশ্নে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে। আছে সামাজিক অনাচার বন্ধের কথাও। কিন্তু জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া আর আর কোনো ক্ষেত্রে সরকার তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। সামাজিক অনাচার, বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার কথা বললেই মন্ত্রী-নেতারা হই হই করে ওঠেন। যদিও জোটের শরিকেরাও মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর বাক্‌স্বাধীনতাও ঝুঁকিতে। তিনি উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, উপজেলা নির্বাচনে শুধু কারচুপি হয়নি, তাঁদের কর্মীরা সেখানে দাঁড়াতেই পারেনি। অপর এক অনুষ্ঠানে এই নেতা বলেছেন, ‘আমাদের এই রাষ্ট্রটি একেবারে লুটেরা পুঁজিপতিদের রাষ্ট্র হয়ে গেছে।’ লুটেরা পুঁজিপতিদের রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার বা সুশাসন আশা করা যায় না। জোটের আরেক শরিক জাসদ সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘সংসদে কোন দল বিরোধী দলে আসবে, সেটি আওয়ামী লীগ ঠিক করে দিতে পারে না।’ তিনি সত্যিকার বিরোধী দল চান, ফরমায়েশি বিরোধী দল নয়।

আওয়ামী লীগের পুরোনো মন্ত্রী ও নতুন মন্ত্রীদের মধ্যেও চাপান-উতোর আছে। সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত ১০ মার্চ জাতীয় সংসদে নতুন মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেন, ‘মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মনে হয়, আগে কোনো কাজই হয়নি, তিনিই প্রথম শুরু করেছেন। এভাবে কথা বলে হিরো হওয়ার চেষ্টা করবেন না।’

বাংলাদেশে অনাচার ও বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় ও প্রাণঘাতী খাত সড়ক পরিবহন। দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ যখন সড়ক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার, তখন পরিবহনশ্রমিক ও মালিকেরা সরকারকে ১০ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাচ্ছেন। গত বছর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর কিশোর-তরুণদের আন্দোলনের মুখে সংসদে সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়, যাতে দুর্ঘটনার দায়ে চালকদের শাস্তির মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। আর হত্যার উদ্দেশ্যে কেউ দুর্ঘটনা ঘটালে তাঁর জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

এখন সরকারের সমর্থক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনই সেই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সড়ক পরিবহনশ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান ও পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। তাঁরা মন্ত্রী থাকাকালে আইনটি পাস হয়। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সমাবেশে শাজাহান খান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিবহন খাতে এখন ১০ নম্বর সতর্কসংকেত চলছে।’ সমাবেশে অন্য বক্তারাও মাঠে নেমে দাবি আদায়ের কথা বলেছেন। তাঁদের দাবি আদায় মানে আইনটি বাতিল করে সড়কে মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘায়িত করা।

সত্যি কথা বলতে, এই মুহূর্তে কেউ স্বস্তিতে নেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দলীয় শৃঙ্খলা নিয়ে বেকায়দায় আছে। আর আওয়ামী লীগ আছে সরকার পরিচালনা নিয়ে। সামনে বাজেট ও রোজা। রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। বাজেটে কর বাড়লে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যাবে। আবার উন্নয়নকাজ চালাতে সরকারের টাকাও লাগবে। এখন কীভাবে সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।