নষ্ট রাজনীতি ও সস্তা গণতন্ত্রের তিন অবস্থা

সস্তায় জিনিস কিনে মানুষ পস্তায়, তাই লোকে বলে—সস্তার তিন অবস্থা। এখন দেখা যাচ্ছে, বাঙালির রাজনীতি ও গণতন্ত্রেরও তিন অবস্থা। বঙ্গীয় গণতন্ত্রে সরকারি দলের এক অবস্থা। বিরোধী দলের একেবারেই বিপরীত অবস্থা, তাদের মাথা চাপড়ানো ছাড়া আর করণীয় কিছু নেই। আর জনগণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনই সর্বোত্তম উপায় মনে করে। অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে, অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল, বিরোধী দল ও জনগণ পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, পরস্পর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে সম্পর্কিত।

পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় একবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর কী প্রসঙ্গে এক বৃদ্ধ নেতাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘ফুরালো বাগানের আম, কী খাবি রে হনুমান।’ ৩০ ডিসেম্বর অনন্যসাধারণ নির্বাচনের পর বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীর পিনপতন নীরবতার মধ্যে আমার ওই বৃদ্ধের কথাটি মনে পড়েছিল।

কোনো নির্বাচনে এক পক্ষের বিপুল জয়লাভ, অন্য পক্ষের ধরাশায়ী হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এবারই এক নির্বাচন হলো, বিপুল বিজয়ের পর সরকারি দলের আনন্দ-উল্লাসের মৃদু প্রকাশও নেই। বিরোধী দলের প্রার্থীরা ধরাশায়ী নন, শয্যাশায়ী হলেন। এতটাই বাক্‌রুদ্ধ হলেন যে প্রতিবাদ করার ভাষাটা পর্যন্ত গলা দিয়ে বের হলো না, রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করা তো দূরের কথা। প্রতিবাদ যেটুকু করলেন, তা অস্পষ্ট, গলার আওয়াজ ফ্যাসফেসে। নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রত্যাখ্যান করা খুব সহজ, কিন্তু প্রত্যাখ্যানের পরে কী করবেন, তা বললেন না। কেউ কথার কথা বললেন, ‘নতুন নির্বাচন চাই’।

জগতে অনেক কিছু যদি চাইলেই পাওয়া যেত, তাহলে সারাক্ষণ মানুষ শুধু চাইত। অথচ নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো নেতার বজ্রকণ্ঠে জনগণের কানে তুলা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে বাক্‌দেবতা ওই সব বজ্রকণ্ঠের সুইচ অফ করে দেন। তাঁদের কথাবার্তা তো বন্ধই, অনেকের দেখাও পাননি তাঁদের প্রতিবেশীরা চার মাসে। ওদিকে জনগণ নিজেদের ভাগ্যবিধাতার হাতে নিজেদের সম্পূর্ণ সমর্পণ করে নিশ্চিন্তে রয়েছে।

যাঁরা মনে করেছিলেন এবং বলাবলি করছিলেন ইংরেজি নববর্ষে আকছার নতুন সরকার গঠন করবেন, তাঁরা সাকল্যে ৬টি আসন পেলেন: শতকরা দুটি করে। ৬ + ২ = ৮ সদস্য দিয়ে যখন সরকার গঠন সম্ভব নয়, সুতরাং জানিয়ে দিলেন, ‘সংসদে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না’ এবং সংসদে যাওয়ার যে পূর্বশর্ত শপথ গ্রহণ করা, তারও প্রশ্ন নেই।

বাঙালির অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো তার সন্দেহবাদিতা। সব ব্যাপারেই তার সন্দেহ। সংসদে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না—এই কথাতেও বাঙালি সন্দেহ পোষণ করে। কেউ যদি বলে আমি বেহেশতে যাব না, সে কথা মানুষ বিশ্বাস করলেও করতে পারে, কিন্তু নির্বাচিত ঘোষণার পর সংসদে যাব না, তা অবিশ্বাস্য।

যে ধরনের নির্বাচনের ফলাফল, তাতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ও জোট যদি অভিমানবশত বলে যে সংসদে যাব না, নতুন নির্বাচন চাই, তাতে অস্বাভাবিকতা বিশেষ নেই। কিন্তু সেটা বলার পরে বিকল্প কী, তা–ও বলা দরকার। তারা যাবে না তো না গেল, তাতে জনগণের কী!

জাতির ভাগ্য নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁরা দায়িত্বশীল মানুষ, তাঁদের কথার ওজন শিমুল তুলার মতো হালকা হতে পারে না, তাঁদের কথা হবে পাথরের মতো ভারী। কথায় কোনো নড়চড় থাকবে না।

দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল আর ঝগড়াপুর সবুজকুঁড়ি ইয়ুথ ক্লাব এক রকম হতে পারে না। ঝগড়াপুর ক্লাবের মেম্বাররা সারা বছর সন্ধ্যায় তাস পিটিয়ে শীতকালে বার্ষিক আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হতে পারে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের তা নয়। জাতির স্বার্থে জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে যা যা করণীয়, তা তাঁদের করতে হয়। রাজনীতিকরনেওয়ালারা কোটি কোটি মানুষের নেতৃত্ব দেন, তাই তাঁরা যেমন–তেমন ব্যক্তি নন। তাঁদের কথার দাম থাকবে।

কোনো পার্লামেন্ট নির্বাচনে যখন কেউ জয়লাভ করেন, তাঁর যথাসময়ে শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়াই স্বাভাবিক। শপথ নেব কি নেব না, সংসদে যাব কি যাব না—এ রকম টালবাহানা তাঁদের শোভা পায় না।

সাধারণ মানুষ মনে করে, সংসদে না যাওয়ার কারণ হিসেবে তাঁদের মনোভাব এ রকম যে সাড়ে তিন শ সাংসদের মধ্যে আধা ডজন মানুষ, তাঁরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না, সুতরাং গিয়ে লাভ নেই। বস্তুত লাভ আছে, সে লাভ খুব বড় লাভ। মর্যাদা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, সম্ভাব্য রাজউকের প্লট, এলাকার স্কুল–কলেজ–মাদ্রাসা ইত্যাদিতে খবরদারি, উপজেলা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসারের ওপর হুকুমদারি, বিদেশ সফর প্রভৃতি কত রকম লাভ। নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এসব সুযোগ হাতছাড়া করা নিজের বুকে নিজে ছুরি মারার শামিল।

নির্বাচনে যে কজন জয়লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ছাড়া আর কেউ দেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত নন। অবস্থা যদি এমন হতো যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সব নেতাই জয়লাভ করতেন, তাহলে কি তাঁরা শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন?

বিএনপির ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপটা গেছে। রাজনীতি করলে তা সইতে হয়, মিথ্যা বা বানোয়াট অভিযোগে আসামি হতে হয়, কারাগারে যেতে হয়, পুলিশের লাঠির পরশ হজম করতে হয়। সরকারের টানা দ্বিতীয়বারের মেয়াদ যখন ফুরিয়ে আসছিল, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছিল, খালেদা জিয়ার সাজার সম্ভাবনা যখন ষোলো আনা, তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল অব্যর্থ, তখন তাঁর উচিত ছিল তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব ঠিক করে দেওয়া। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে যা যা করণীয়, তা নির্ধারণ। একটা উপায় যদি সুবিধাজনক না হয়, তার বিকল্প রাখা। কাগজপত্রে যিনি দলের নেতা, তিনি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে স্বেচ্ছানির্বাসিত। সেখান থেকে পাঠানো তাঁর ফরমান জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়।

সরকারের অধীনেই যখন নির্বাচন করতে হবে, তখন সরকারের সঙ্গেই বিএনপির বোঝাপাড়া করলে ভালো হতো, গণফোরামের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার প্রয়োজন ছিল না। তাতে গণফোরামেরই অকল্পনীয় উপকার হয়েছে, বিএনপির ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়।

নির্বাচিত ঘোষিত হওয়ার পর শপথ নিয়ে যাঁরা সংসদে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা ভুল করেননি, দোষও করেননি। দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকেন, সে দায় থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন না। অবশ্য প্রথম থেকেই দলের নেতাদের কথাবার্তায় ভারসাম্য ছিল না, শেষ পর্যায়ে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাঁর নৈতিক বিজয় হয়েছে। রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে তাঁর দলের। তাঁর দল তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি প্রতারণার শিকার। বিষ খেয়ে বিষ হজম করেছেন। ঘটনাবহুল বাংলাদেশে রাজনীতিতে তাঁর শপথ না নেওয়া এবং তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা বিরল ঘটনা। তাঁর ঘটনাটিতে বিএনপির দেউলিয়াপনার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। রাজনীতিকরনেওয়ালাদের ওপর মানুষের আর আস্থা-ভরসা রইল না।


সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক