ক্রীড়াঙ্গনে নারীর সাফল্য

বাংলাদেশের মেয়েরাও যে ফুটবল পায়ে মাঠ কাঁপাতে পারেন, ক্রিকেট ব্যাট হাতে ছক্কা হাঁকাতে পারেন, ভারোত্তোলনে আন্তর্জাতিক আসরকে উল্লসিত করতে পারেন—বছর ১৫ আগেও এমনটি ভাবা যেত না। সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ধ্যানধারণা বঙ্গসমাজে চলে আসছিল যে, ‘মেয়েরা দুই জাতের...এক জাত প্রধানত মা, আরেক জাত প্রিয়া। ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যায় যদি, মা হলেন বর্ষা ঋতু। জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব। আর প্রিয়া বসন্ত ঋতু। গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়ামন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ...।’

কিন্তু গত এক দশকে এই ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছেন এ দেশের নারী খেলোয়াড়েরা। ‘ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা মেয়েদের মানায় না’—এই ধারণা থেকে দেশবাসীর মানসিকতাকে তাঁরা অনেকটাই সরিয়ে এনেছেন। সাফল্যের শুরুটা যাঁদের হাত ধরে এসেছে, সেই নারী খেলোয়াড়দের বহুরৈখিক সংগ্রাম ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

নারী ফুটবলের সাফল্যের প্রসঙ্গ এলেই অবধারিতভাবে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েদের কথা উঠে আসে। চরম সুবিধাবঞ্চনার মধ্যে থাকা এই মেয়েদের সামনে ছিল হাজার বাধা। প্রান্তিক পরিবারের দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই মেয়েরা গোড়ার দিকে না পেয়েছেন উন্নত প্রশিক্ষণ, না পেয়েছেন উৎসাহ-উদ্দীপনা। উল্টো সামাজিকভাবে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বাধা ডিঙিয়ে তাঁরা সাফল্যের মুকুট ছিনিয়ে এনেছেন। কলসিন্দুরকন্যারা এখন বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেন।

নারী খেলোয়াড়দের সেই স্বপ্ন যে দিবাস্বপ্ন নয়, তা তাঁরা বারবার প্রমাণ করেছেন। সর্বশেষ বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ফুটবলে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা তা প্রমাণ করেছেন। কলসুন্দরকন্যা তহুরা খাতুন যখন জাতীয় দলের স্ট্রাইকার হিসেবে রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে ‘বর্ষসেরা নারী’র সংবর্ধনা নেন, তখন তাঁর দরিদ্র বাবা ফিরোজ মিয়ার চোখে আনন্দাশ্রু নামে। সে আনন্দে গোটা বাংলাদেশ উদ্বেলিত হয়।

বাংলাদেশের ছেলেদের ক্রিকেট দল এখনো কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জিততে পারেনি। কিন্তু গত বছরের জুনে বাংলাদেশের মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট দল ছিনিয়ে এনেছে এশিয়া কাপ। এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা জিতে বাংলাদেশের মাবিয়া আক্তার পদক নেওয়ার সময় যখন পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সুরে অঝোরধারায় কাঁদেন, তখন কোটি কোটি বাংলাদেশির চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।

সদ্য সমাপ্ত বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাংলাদেশের কিশোরী মনিকা চাকমা। সাতক্ষীরার ফুটবলার সাবিনা খাতুন বিদেশি কোটায় ভারতে ও মালদ্বীপের ক্লাবে খেলেছেন। ভারতে মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগে (আসরটিকে মেয়েদের আইপিএলও বলা চলে) বাংলাদেশের প্রথম কোনো নারী ক্রিকেটার হিসেবে খেলছেন বাংলাদেশের জাহানারা আলম।

ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের এই সাফল্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ। বলা যায়, দেশের মেয়েরা তাঁদের প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। এখন সেই প্রতিভার যথাযথ পরিচর্যা দরকার। তার দায় সরকারের। সেই দিকে খেয়াল রেখে প্রান্তিক পর্যায়ের নারী খেলোয়াড়েরাও যাতে পর্যাপ্ত পুষ্টি পান, তুলনামূলক স্বচ্ছন্দে চলতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আশার কথা, সরকারের দিক থেকে নারী খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ধারাকে আরও এগিয়ে নেওয়া দরকার। শ্যামল কোমল নারীর মধ্যে যে ‘বহ্নিশিখা’ রয়েছে, তাকে দেদীপ্যমান করে তোলা এক সুপ্ত জাতীয় আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের ডাক দিচ্ছে সময়। সময়ের সেই ডাক শুনতে হবে।