বিএনপির ছুটির ঘণ্টা কি বেজে গেছে?

বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত চারজন সংসদ সদস্য কয়েক দিন আগে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে স্পিকারের কাছে শপথ নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি মনে হচ্ছে বিএনপির ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া কিংবা অ্যান্টি-ক্লাইমেক্সের চূড়ান্ত। কোনো কারণে হঠাৎ ঝাঁকুনি খেলে সংবিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে মানুষের আচরণ বা মনোভাব একটি শব্দ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা থাকে—কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের, এমনকি বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর অবস্থা অনেকটা এ রকম।

এত দিন বিএনপির সংসদে না যাওয়ার পক্ষে যাঁরা শত যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, তাঁরা অনেকেই এখন সংসদে যোগ দেওয়ার পক্ষে হাজারো যুক্তি বের করছেন। সুযোগ পেলেই তাঁরা মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার করতে ছাড়েন না—রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

সংসদে না গেলে কী অর্জন হবে এবং গেলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে, এ নিয়ে দলের ভেতরে বা বাইরে হয়তো অনেক আলোচনা হয়েছে। শেষমেশ তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে এলেন। বিএনপির কট্টর শুভাকাঙ্ক্ষী জাফরুল্লাহ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, সিদ্ধান্ত সঠিক, কিন্তু পদ্ধতি ভুল। স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মাধ্যমেই এ সিদ্ধান্তে আসা যেত। তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিএনপির অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী এবং পরামর্শদাতা আছেন। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র চেয়ারপারসনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা দিয়েছে। এটা একটা প্রচলিত ধারণা যে গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সচেতন অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা। যেখানে এ সুযোগ যত কম, গণতন্ত্র সেখানে ততই নাজুক। এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে যদি দল চলে, তাহলে অন্যরা কেন এই দল করবেন বা এই দলের শুভানুধ্যায়ী হবেন, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকা দরকার। তবে যাঁরা এই দলে আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দলের এই নিয়ম মেনেই রাজনীতি করছেন। বাইরের লোক এ নিয়ে কী ভাবল বা না ভাবল, তাতে কী আসে-যায়।

রাতের টক শো বা সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি শুনে এবং পড়ে মনে হচ্ছে, বিএনপি এত দিনে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটুকু ‘স্পেস’ পাওয়া যায়, তা-ই লাভ। তারপরও নিন্দুকেরা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন তুলছে—তাহলে জল এত ঘোলা করার কী দরকার ছিল। সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি? এ যেন হাল আমলের বলিউড-ঢালিউডের বাজারি ছবির মতোই। রোমান্স, সেক্স, ভায়োলেন্স, কমেডি, সাসপেন্স—সবকিছুর মিশেল থাকতে হয়। বিএনপি এত দিন আমজনতাকে ‘সাসপেন্সে’ রেখেছিল।

রাজনীতিবিদেরা কি কখনো প্রকাশ্যে বলেন যে তাঁরা ভুল করেছেন? তাঁদের দাবি, তাঁরা সব সময় সঠিক কাজটিই করেন। সংসদে না যাওয়া নিয়ে তাঁদের এত দিনের ভূমিকা নিশ্চয়ই সঠিক ছিল। এখন সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিই সঠিক। সাধারণ মানুষ কিংবা তৃণমূলের কর্মীরা আসলেই নির্বোধ। তাঁরা বুঝতে পারেন না কিসে তাঁদের মঙ্গল। সে জন্যই তো তাঁদের হেদায়েত করার জন্য নেতার প্রয়োজন।

নেতা সব জানেন, সব বোঝেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন, অন্যরা তা নির্দ্বিধায় পালন করবেন। তা না হলে দলে শৃঙ্খলা থাকে না। এটাই হলো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মাজেজা।

তরুণ বয়সে আমরা অনেকেই ‘ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম’ নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়েছি এবং কথার তুবড়ি ছুটিয়েছি। এটা এ দেশে আমদানি হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে। তখন হরহামেশা তাদের মুখে এ ধরনের বচন শুনতাম, ‘আমরা জনগণের সস্তা সেন্টিমেন্টের লেজুড়বৃত্তি করি না, আমরা তাদের নেতৃত্ব দিই।’ এখন এটি মোটামুটি পরিষ্কার, রাজনীতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনা সূক্ষ্মতর আর্ট। এখানে ভাবাবেগের জায়গা নেই। যিনি নেতা, তিনিই তো সবার চেয়ে বেশি জানেন এবং বোঝেন। এটা চ্যালেঞ্জ করার অর্থ হলো দলের ঐক্য নষ্ট করার পাঁয়তারা। এঁরা দলের শত্রু, এমনকি দেশেরও।

বিএনপির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে এ সময়ের সেরা ‘পলিটিক্যাল সমারসল্ট’ বা রাজনৈতিক ডিগবাজি হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। ঘটনা পরম্পরায় আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো: এক. দলের ওপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে। দলের নেতৃমণ্ডলীতে ২০০১ সালে তাঁর উত্থান হলেও এখন তিনিই কান্ডারি। তিনিই সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য তিনি কারও সঙ্গে পরামর্শ করবেন কি না, সে সিদ্ধান্তও তাঁরই। দুই. তাঁর অপছন্দের লোকদের তিনি আর নেতৃত্বে দৃশ্যমান দেখতে চান না। আমার মনে হলো, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘মাইনাস’ হয়ে গেলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি ভাঙবে? দলের ‘আংকেলদের’ সঙ্গে তারেক রহমানের রসায়নটি কার্যকর নেই, এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনেক দিন আগে বাজারে একটা কথা চাউর হয়েছিল, ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছিল এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনে গিয়ে ভুল করেছে। দুটো সিদ্ধান্তের পেছনেই তারেক রহমানের দায় আছে বলে শোনা যায়।

বিএনপির মহাসচিবের কথা হলো, চারজনের সংসদে যাওয়া এবং তাঁর না যাওয়া উভয়ই দলের সিদ্ধান্ত এবং কৌশল। সংরক্ষিত নারী আসনের একটি বিএনপির ভাগে পড়বে। আগামী কয়েক দিন এ নিয়ে সম্ভাব্য নারী প্রার্থীরা টক শো গরম রাখবেন এবং তারেক রহমান যে একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ, সেটা জানপ্রাণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাবেন। কেননা এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত দেবেন তারেক। ইতিমধ্যে তাঁর আরও আস্থাভাজন হওয়ার দৌড়ে শামিল হয়েছেন কেউ কেউ এবং মহাসচিবের ভূমিকার সমালোচনাও শুরু হয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগ, তথা সরকার এখন দারুণ স্বস্তিতে। সবকিছুই হচ্ছে তাদের ছক কিংবা পছন্দ অনুযায়ী। বিএনপিকে নির্বিষ করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পাশে বড় দালানটিতে দলটির কয়েকজন ‘প্রতিনিধিকে’ ঢোকাতে পেরেছে তারা। সরকারের এ কৌশল অনন্য। বিএনপিও বলছে কৌশলের কথা। আমার মনে হয়, সবে তো শুরু হলো খেলা।

বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু ‘হিসাব’ ইতিমধ্যে মীমাংসিত। যেটুকু অমীমাংসিত রয়ে গেছে, এবার তা সুদে-মূলে আদায় করে ছাড়বে আওয়ামী লীগ। অতীতে আমরা অনেক জনপ্রিয় এবং বড় বড় দলকে দেখেছি, যাদের একসময় আওয়ামী লীগের বিকল্প, ক্ষমতার রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার সামর্থ্য রাখে বলে মনে হতো। এদের মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ, কেএসপি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং জাসদ। এদের এখনকার হাল আমাদের জানা। গত তিন দশকজুড়ে বিএনপি ছিল আওয়ামী লীগের বিকল্প। এখন তার মধ্যে ভাটার টান। আবার জোয়ার আসবে বলে মনে হয় না। যদিও আসে, সেটা হয়তো নতুন কোনো শক্তির পক্ষে। বিএনপির ছুটির ঘণ্টা কি বেজে গেছে?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]